দৃষ্টিপাত

‘সাঁওতাল জন্যে কি বিচার পাবার নই?’

Looks like you've blocked notifications!

গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মাদারপুর গ্রামে ৯ নভেম্বর যখন পৌঁছালাম, তখন দুপুর ২টা। সেখানে একটি গির্জার সামনে তিন দিন আগে গৃহ থেকে উচ্ছেদ হওয়া কয়েকশ নারী-পুরুষ, যাদের সম্পদ বলতে শুধু শরীরের পোশাকটুকু। তিন দিন থেকে তাঁরা সকলেই অর্ধাহারে-অনাহারে। মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকালেই ক্ষুধার্ত মানুষ বলে চিনতে অসুবিধা হয় না।

আক্ষরিক অর্থেই তাঁরা এখন একটি গ্রামে বন্দি জীবনযাপন করছিলেন। গ্রামের সীমানা পার হলেই কিছু দুর্বৃত্ত প্রচণ্ড নির্যাতন করছিল। কারা করছে—এ প্রশ্নের অনেকেরই সন্দেহের তীর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দিকে। সেদিন ঠাকুরগাঁও থেকে ‘মাদার তেরেজা’ নামে একটি সংগঠন দেড়শ পরিবারের মধ্যে পরিবারপ্রতি ছয় কেজি চাল, দুই কেজি মশুর ডাল, আধলিটার তেল, একটি শাড়ি ও একটি লুঙি দিচ্ছিল। একজন মলিন মুখে বলছিলেন, ‘চাউল পাইলাম। কিন্তু কোথায় রান্না করি খামো, জানি না।’ বেহুলা মুরমু নিজের জীর্ণ-ছেঁড়া একটি জামা দেখিয়ে বলছিলেন, ‘এইটা ছাড়া আর কিছুই নাই হামার। বাড়ি পুড়ি দিছে। হামার রক্ত গেইচে। মরি গেইলেও বাপ-দাদার জমি ছাইরবার নই।’ কয়েকজন মহিলা পায়ের কাছে আহাজারি করতে করতে বলছিলেন, ‘বাবা, হামার উপকার করো। বাবা হামার উপকার করো।’ মিনি মার্ডি বলছিলেন, ‘১৯৭১ সালেও একসাথে এত গুলির শব্দ শুনি নাই।’

খাদিজা নামের একজন চোখের পানি মুছতে মুছতে বলছিলেন, ‘আশা’ আর ‘বিআরডিবি’ থেকে লোন নিয়ে ঘর করেছেন। একটা চায়ের হোটেল দিয়েছেন। তাঁর সব পুড়ে গেল। আশার লোক কিস্তির টাকা চাইছে। কেমন করে টাকা দেবেন? সোনা মুরমু বলছিলেন, ‘সাঁওতাল জন্যে কি বিচার পাবার নই?’

‘সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটি’র আহ্বায়ক ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সদস্য অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম, অরূপ রাহী, স্বপন আদনান, মুশাহিদা সুলতান, গণসংহতি আন্দোলনের ফিরোজ আহমেদসহ আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম। আইনগতভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজটি করার জন্য তাঁরা সরেজমিন পরিদর্শনে এসেছিলেন। এরই মধ্যে জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের নির্দেশে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাঁওতালদের হাত থেকে হাতকড়া খুলে দেওয়া হয়েছে।

১৯৬২ সালে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের উদ্যোগে রংপুর চিনিকলের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের শর্তানুযায়ী ১৮৪২.৩০ একর জমি জমিতে আখ চাষ করা না হলে তার মালিকানা আগের মালিক ফিরে পাওয়ার কথা। যত দিন পর্যন্ত জমিতে আখ চাষ হয়েছে, তত দিন পর্যন্ত জমির পুরাতন মালিকরা কোনো দাবি করেননি। কিন্তু কয়েক বছর থেকে জমিতে ধান-পাট-সরিষাসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করা হচ্ছিল। তখন ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে আন্দোলন গড়ে তোলেন ভূমির পুরাতন মালিকরা। ২০১৫ সালে এ কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী প্রধান জেলা প্রশাসক বরাবর জমি উদ্ধারের জন্য লিখিত আবেদনও করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিলেন। সেই কমিটির সদস্যরা রংপুর সুগার মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আখের পরিবর্তে কেন অন্য শস্য উৎপাদন করা হচ্ছে। সুগার মিলস লিমিটেড কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের ২০০৯ সালের একটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবাদযোগ্য জমি লিজ প্রদান করে এবং আখ ছাড়াও অন্যান্য শস্য উৎপাদন করে থাকে বলে উল্লেখ করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ভূমি অধিগ্রহণের সময়ে যে শর্তারোপ করা হয়েছে, তা তো ভূমির মালিকদের সঙ্গে। সেই শর্তের যদি পরিবর্তন হয়, তাহলেও জমির পুরাতন মালিকদের সঙ্গে আলাপ করেই করার কথা। কিন্তু তা না করে চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের এ সিদ্ধান্ত দিতে পারার কথা নয়।

২০১৬ সালের জুলাই মাসে জমির পুরাতন মালিকদের কয়েকশ পরিবার সেখানে বসতি গড়ে তোলে। গত ৬ নভেম্বর রংপুর সুগার মিলস লিমিটেডের কর্মচারীরা পুলিশ নিয়ে এলে বসতি স্থাপনকারীদের সঙ্গে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। ওই দিনই বিকেলে পুলিশ-র‌্যাব-স্থানীয় সাপমারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লোকজন এনে উচ্ছেদের নামে প্রথমে লুটপাট করে কয়েকশ পরিবারের সব ঘর পুড়ে দেয়। সকালে শুরু হয় জমিগুলো চাষ করা। চাষ করা এলাকায় যেতেই চোখে পড়ল মাটি আর ছাই একাকার হয়ে আছে। উচ্ছেদ প্রসঙ্গে সরেজমিন পরিদর্শনে আসা অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম বলেন, ‘উচ্ছেদ করতে হলে তারও আইন আছে। উচ্ছেদের আগে নোটিশ করতে হয়। সরকার যে কাজটি করেছে, সেটি উচ্ছেদ নয়, এটি বসতিতে অগ্নিসংযোগ, নরহত্যা এবং লুটপাট।’

এ ভূমির সঙ্গে আছে অনেক ভোটের সম্পর্ক। সে কারণে সাপমারা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি’ প্রতিষ্ঠার সময় অনেক বড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শুধু তাই নয়, এ সংগঠনটির তিনি সভাপতিও হন। বর্তমান এমপি অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদও সংগঠনটির প্রতিষ্ঠালগ্নে অনেক সহযোগিতা করেছেন। এ দুজনই গোবিন্দগঞ্জ-গাইবান্ধায়, এমনকি ঢাকায়ও ভূমি উদ্ধারের জন্য মানবনবন্ধন করিয়েছেন। ষাটোর্ধ্ব পরগাণা কুজুর বলছিলেন, ‘হেরাই আমাদের ঢাকায়ও মানবন্ধন করাইচে। এখন হেরাই আমাদের বাড়ি পুড়ি দিল।’ কেন এমন করছে—এ কথার জবাবে অনেকেই বলছিলেন, ভোট নেওয়া শেষ, তাই এখন আর আমাদের সঙ্গে নেই।

সংঘাতে আদিবাসী মারা গেছেন তিনজন। কয়েকজন নিখোঁজ। রংপুর মেডিকেলে চিকিৎসা নিচ্ছেন দুজন। একজনের চোখে বুলেট লেগেছে। তাকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। রংপুরে চিকিৎসাধীন চরণ সরেন বলছিলেন, তিনি আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। সেখানে এসে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। হাসপাতালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন, হাতে পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে রেখেছে। তাঁদের পাশে আত্মীয়স্বজন গ্রেপ্তারের ভয়ে আসতেও পারছিলেন না। বিজ্ঞানচেতনা পরিষেদের রায়হান-লিপি-সোহাগ সেবকের কাজ করেছেন। শুধু তাই নয়, চিকিৎসার টাকা সংগ্রহ করার কাজও করেছেন তাঁরা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁদের হাজতে নিয়েছিল পুলিশ। পরে তাঁরা জামিনে মুক্ত হয়ে এখন ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।