শুভ জন্মদিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

Looks like you've blocked notifications!

১৯৯০ সালের ৩১ জুলাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে পাস হয়। ১৯৯১ সালের ২৫ নভেম্বর মোট চারটি ডিসিপ্লিনে ৮০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। ২৬ বছর শেষ করে ২৭ বছরে পদার্পণ করল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। এর পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি সন্ত্রাস, সেশনজটমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম অর্জন করে আসছে। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। ১০১ দশমিক ৩১ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিশাল এ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে তিনটি একাডেমিক, একটি লাইব্রেরি ও প্রশাসনিক ভবন এবং অপরাজিতা, খানজাহান আলী, খানবাহাদুর আহছানউল্লাহ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল নামে পাঁচটি আবাসিক হল।

অন্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান পার্থক্য হলো শিক্ষা কার্যক্রম চালুর পর থেকে সেশনজট, সন্ত্রাস ও রাজনীতিমুক্ত পরিবেশের ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ছাত্র সংঘর্ষের কারণে কোনো ছাত্রের রক্তে রঞ্জিত হয়নি ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাস। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে দেশের অন্যতম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, যার ক্যাম্পাসের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের ঐতিহ্যের ধারা এখনো অক্ষুণ্ণ রয়েছে। এখানে প্রশাসনিক ভবন থেকে শুরু করে একাডেমিক ভবন, হল, ক্যাফেটেরিয়া কোথাও কোনো ভবনের গায়ে লেখা নেই কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের স্লোগান। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে সারা দিন কাটালেও কেউ শুনতে পাবে না কোনো স্লোগান, কোনো উচ্চ স্বরে শব্দ।

ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে যাঁর মতো ব্যস্ত। সময়মতো ক্লাস হচ্ছে, পরীক্ষা হচ্ছে এবং নির্ধারিত চার বছর মেয়াদেই শিক্ষাকোর্স শেষ হচ্ছে। উপকৃত হচ্ছে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক; উপকৃত হচ্ছে দেশ। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, পরিবেশ ও সুখ্যাতির জন্য নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতি সেশনে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল এবং পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হয় অতিথি শিক্ষার্থী।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নতুন ১৪টি ডিসিপ্লিন এবং দুটি ইনস্টিটিউট চালুসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবলের সাংগঠনিক কাঠামো বা অর্গানোগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাভ করেছে, যাতে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি স্কুলের অধীনে আরো ১৪টি নতুন ডিসিপ্লিন এবং দুটি ইনস্টিটিউট খোলার প্রস্তাব রয়েছে। ইতিহাস ও সভ্যতা, সাংবাদিকতা, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট এবং আইন ডিসিপ্লিন এরই মধ্যে চালু হয়েছে। ভবিষ্যতে চালু হবে এডুকেশন ডিসিপ্লিন, ভেটেরেনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, পাবলিক হেলথ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, ড্রামা অ্যান্ড মিউজিক ডিসিপ্লিন এবং দুটি ইনস্টিটিউট ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইআইসিটি) এবং ইনস্টিটিউট অব কোস্টাল জোন অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট।

আগামী ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে মোট ডিসিপ্লিনের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩২টি। এ সময় বর্তমান পাঁচ হাজার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা থেকে ১১ হাজার ৯৫ জনে উন্নীত হবে এবং শিক্ষক সংখ্যা ৩০০ থেকে বেড়ে হবে ৮২১ জন। অর্গানোগ্রামের ভিশন হিসেবে যুগের চাহিদা উপযোগী ডিসিপ্লিন চালুর মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সম্প্রসারণ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ শিক্ষাধারার পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রেখে আরো গুণগত মান অর্জন ও উৎকর্ষ সাধনে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আগামী ১০ বছরের জন্য প্রণীত এ অর্গানোগ্রাম বস্তবায়িত হলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে অনেক দূর এগিয়ে যাবে এবং দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারবে।

বিশ্ববিদ্যালয় কেবল শিক্ষাদানের জন্যই নয়, বরং গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও দিকনির্দেশনা প্রদানে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মানুষ্যসৃষ্ট কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা ঝুঁকি মোকাবিলার পন্থা উদ্ভাবনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাস উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান জাতি প্রত্যাশা করে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর গত ২৬ বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয় দেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র অবস্থান সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। তিলে তিলে গড়ে ওঠা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গত ২৬ বছরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আজ একটি প্রত্যাশিত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মো. ইফতেখার শামস ও ফার্মাসি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. শেখ জামাল উদ্দিন গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য এ বছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছে। দেশ-বিদেশে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং দেশের সুনাম ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুমুখী গবেষণায় জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সরকারি-বেসরকারি, দেশি-বিদেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় বহুসংখ্যক গবেষণা প্রকল্পের কাজ চলছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করলেও রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা। রয়েছে হলের সংকট। ভালো মানের একটা মেডিকেল সেন্টার। ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য বাসের স্বল্পতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য আবাসন ও শ্রেণিকক্ষের স্বল্পতা। এ সীমাবদ্ধতা শুধু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কমবেশি এ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে আশার কথা, বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানের দক্ষ নেতৃত্বে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অঙ্কের উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেক। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে ১৮৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকার এ উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে এপ্রিল-২০১৬ থেকে জুন-২০২১ সাল পর্যন্ত। অনুমোদিত এ প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য অবকাঠামোগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, ছাত্রী হলের পার্শ্বমুখী ও ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, ১০তলা ভিতে চতুর্থ একাডেমিক ভবন নির্মাণ, শিক্ষক, কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন নির্মাণ ১১ তলা, শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর) ভবন নির্মাণ, গেস্টহাউস, ডরমিটরি কাম ক্লাবের পার্শ্বমুখী ও ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন ভবন এবং অডিটরিয়াম নির্মাণ, মেডিকেল সেন্টার নির্মাণ, জিমনেশিয়াম, কেন্দ্রীয় মসজিদ নির্মাণ, প্রশাসনিক ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, আসবাবপত্র ক্রয়, ক্যাম্পাসের বাউন্ডারি ও ওয়াল নির্মাণ, ক্যাম্পাসে ড্রেনেজ নির্মাণ। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত স্বল্পতা থাকবে না এবং আরো নতুন নতুন ডিসিপ্লিন খোলা সম্ভব হবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় খুলনাবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। খুলনাবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু খুলনাবাসীর স্বপ্ন পূরণ করছে তা নয়, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও রাখছে সমান ভূমিকা। দীর্ঘ ২৬ বছরের চলার পথে অনেক ছোটখাটো সমস্যায় পড়তে হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কিন্তু প্রশাসনিক দক্ষতা এবং নগরবাসীর সহযোগিতায় সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান হয়েছে। তাই এই দিনটি খুলনাবাসীর জন্য সত্যিই শুভ। ‘শুভ জন্মদিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়’, শুভ হোক আগামীর পথচলা।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।