পাঠকের কলাম

খাদিজার ফিরে আসা, অতঃপর...

Looks like you've blocked notifications!

সিলেটের আউশা গ্রামের মেয়ে খাদিজা আক্তার নার্গিস। প্রবাসী বাবার একমাত্র মেয়ের কত যে স্বপ্ন ছিল! কৈশোরের দুরন্ত সময়ে গ্রামের সবুজ আবহে বেড়ে ওঠা সহজ-সরল তাঁর মনটা নিয়ে খেলা শুরু করেছিল বখাটে বদরুল। ফুসলিয়ে প্রেমের বাঁধনে ফেলল তাকে। নানা যন্ত্রণায় প্রেমিক নামক এ ঘাতকের সঙ্গে আট বছরের প্রেমের সম্পর্ক চুকিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল সে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি! শেষের কাহিনীটা যে এতটা করুণ হবে, তা কি ঘুণাক্ষরে টের পেয়েছিল খাদিজা ও তার পরিবার? গৃহশিক্ষক থেকে প্রেমিক—অতঃপর ঘাতকের চরিত্রে অবতীর্ণ হয়ে নৃশংস খেলায় মেতে ওঠে চাপাতি বদরুল, যার পরিণতি হতে চলেছিল খাদিজা মৃত্যুপ্রায় সংকটকাল। বিধাতার ইশারায় খাদিজা এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে। জীবনে তাঁর সংকট নেই ঠিকই, কিন্তু এত কিছুর পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কি নতুন জীবন পাওয়া খাদিজা? 

সিলেট শহর থেকে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক ধরে একটু এগোলেই শহরতলির আউশা গ্রাম। এই গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা এ ঘটনার পর ক্ষুব্ধ আন্দোলন করেছিল, সঙ্গে জেগেছিল দেশবাসী। বদরুলের বিচারিক প্রক্রিয়াও শুরু হলো। এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে সংগঠিত নৃশংসতার শিকার খাদিজা আক্তার নার্গিসের দোষীর শাস্তির গণদাবি আজ আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে, যেভাবে আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে খাদিজার জীবন। সংকটকাল এখন আর নেই। খাদিজার লাইফসাপোর্ট দেওয়া সে সময়ের অবসান হয়েছে আগেই। এখন সাভারের সিআরপিতে চলছে তাঁর আরেক ধাপ চিকিৎসা প্রক্রিয়া। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে তাঁর আরো সময় লেগে যাবে। এরই মধ্যে খাদিজা বাড়ি ফেরার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান। এরপর তিনি ফিরবেন তাঁর চিরচেনা মেঠোপথের গ্রামে, যেখানে জড়িয়ে আছে তাঁর জীবনের হাজারও স্মৃতি। আশা করা যায়, তিনি একদিন তাঁর কলেজের ফিরবেন। বন্ধুদের সঙ্গে মিলবেন। চাইলে হয়তো দেখে নেবেন তাঁর আক্রান্ত হওয়ার সেই স্থান!

গত ৩ অক্টোবর সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের (ডিগ্রি) ছাত্রী খাদিজা পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে শাবি শিক্ষার্থী বদরুল আলমের হামলার শিকার হন। মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে প্রথমে খাদিজাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অস্ত্রোপচারের পর অচেতন অবস্থাতেই খাদিজাকে ওই দিন দিবাগত রাতে তাঁর স্বজনরা স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সংকটজনক অবস্থাতেই খাদিজার মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের ৯৬ ঘণ্টা পর চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, ‘খাদিজার আর জীবন সংশয় নেই।’ সে কথা সত্য হতে চলল। আর মাত্র কয়েক দিন পর তিনি ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে। সে মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা করছে সবাই।

এ ঘটনার পর ক্ষোভে ফেটে পড়ে সারা সিলেট। বিক্ষোভে উত্তাল জনতা প্রতিবাদ করতে থাকে সারা দেশ থেকে। ঘাতক বদরুলের বিচার চেয়ে রাস্তায় নেমে আসে ছাত্র-জনতা। সবারই প্রত্যাশা ছিল, খাদিজা সুস্থ হয়ে ফিরবেন প্রিয়জনের মধ্যে। প্রিয় ক্যাম্পাসের বান্ধবীদের সঙ্গে মিলবেন তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে। গ্রামের চিরচেনা মেঠোপথে আবারও আলো ছড়াবেন খাদিজা। শারীরিক অবস্থার যেভাবে উন্নতি হচ্ছে তাতে খাদিজার মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে ফিরে আসাটা এখন সময়ের ব্যাপার। সমাজের কাছে বিবেকের দায়বদ্ধতা বাড়িয়ে দিতে খাদিজার এই বেঁচে থাকা হবে প্রেরণার। বদরুলের মতো ঘাতকের মুখে চুনকালি দিতে খাদিজার ফিরে আসাটা আজ খুব বেশি প্রয়োজন ছিল।

সবকিছুর পরও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। তাঁর পরবর্তী জীবনটা কেমন হবে? সত্যিই কি খাদিজা পড়াশোনায় ফিরতে পারবেন? পারবেন কি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে? সাধারণ মানুষের এই সহানুভূতিসম্পন্ন মানসিকতা তিনি কত দিন পাবেন? তাঁর বন্ধুরা তাঁর সঙ্গে আবারও হেসে কথা বলবেন তো? বদরুলের যদি শাস্তি না হয়, যদি তিনি আবার সমাজে ফিরে আসেন। খাদিজা ও তাঁর পরিবারের অবস্থা তখন কী হবে? খাদিজার বেঁচে থাকাটা এ সমাজ কীভাবে ব্যাখ্যা করবে? পরিবার হয়তো তাঁর পাশে থাকবে আজীবন; কিন্তু অন্য কোনো বদরুলের আবার জন্ম হবে না তো সমাজে! জীবনের প্রয়োজনে সে কি সহানুভূতি নিয়ে বাঁচবে, না নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে সব জঞ্জালের মুখে প্রতিবাদী নারীর প্রতীক হয়ে সমাজকে পথ দেখাবে?

লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।