তারপরও রাগ করতে পারিনি যে কারণে...

Looks like you've blocked notifications!

গতকাল রাগ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যথেষ্ট কারণ থাকার পরও সেই রাগটা আর শেষ পর্যন্ত করা হয়নি।

রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি থেকে সন্ধ্যায় ফার্মগেট হয়ে যেতে চেয়েছিলাম ধানমণ্ডির ২৭ নম্বরে। সন্ধ্যা ৬টায় মানিক মিয়া এভিনিউতে সেই যে ঢুকে বসে রইলাম, গাড়ি নড়েও না, চড়েও না। রাত পৌনে ৯টা পর্যন্ত গাড়ি নট নড়ন চড়ন অবস্থাতেই রইল। বাচ্চারা এর মধ্যেই কয়েকবার গাড়ির ভেতরেই ঘুমাল। ঘুম থেকে উঠে বারকয়েক জিজ্ঞেসও করল, আমরা সবাই বাসায় চলে এসেছি কি না!

এদিকে সড়কের একপাশটা বন্ধ করে দিয়ে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান চলছিল। গাড়িতে বসে বসেই কিছু কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম মমতাজসহ অন্য শিল্পীরা গাইছেন। সময়টাকে জমিয়ে তোলার জন্য আমি কয়েকবার বাদাম-বুট-ছোলা-মুড়ি-আইসক্রিম এনে বাচ্চাদের দিলাম। গাড়ির চালককেও বললাম, খেতে থাকো আর গান শোনো। এরই মধ্যে অনুষ্ঠানের ঘোষকের সহায়তার মানুষের জট খুলে সেই জনসমুদ্র পার হতে পারলাম। যারা গতকালকে সন্ধ্যায় যারা ওই রাস্তায় ঢুকে পড়েছিলেন, তাদের প্রত্যেকের একই দশা হয়েছিল।

গাড়িতে বসে বসে ২০ বছর আগে গাজীপুরে সেই প্রবীণ বাসযাত্রীর কথা বারবার মনে পড়ছিল। সত্যি বলতে কি, সেই মুরব্বির কারণেই এদিন আমার আর রাগ করা হয়ে উঠল না। সেদিনকার সেই গল্পটাই আজ বলছি।

ঢাকা থেকে গাজীপুর দিয়ে একই বাসে যাচ্ছিলাম টাঙ্গাইলে। ১৯৯৭ সালের ১৭ এপ্রিলের সেই দিন। অনেকের কানের কাছেই তখন রেডিও চালু করা, কেউ কেউ রেডিও শুনছে হেডফোন লাগিয়ে। টানটান উত্তেজনার ক্রিকেট খেলা। আইসিসি ট্রফির ফাইনাল। ধারাভাষ্যকার চৌধূরী জাফরুল্লাহ শরাফাত অনেকটাই এ রকম বলে যাচ্ছেন,

‘...মালয়েশিয়ার কিলাত কিলাব মাঠ থেকে আমি চৌধূরী জাফরুল্লাহ শরাফাত। দরকার ১ বলে ১ রান। গর্ডন গ্রিনিজ, আকরাম খান, সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন অনেক আগেই। ব্যাটিং প্রান্তে হাসিবুল হোসেন শান্ত।

‘কেনিয়ার মারটিন সুজির লেগ সাইডের বল পায়ে লেগে লেগ বাই, শান্তকে শান্ত রাখা গেল না। রান নিয়ে ছুটলেন টিমের সাজঘরে। আরেক নায়ক খালেদ মাসুদ পাইলটও ছুটলেন। রচনা হলো ইতিহাস।’

মুহূর্তে বিজয়ের এই খবরে পুরো বাসই উল্লাসে মেতে উঠেছে। গাজীপুরের স্থানীয় কিশোর-যুবক-দোকানদাররা বালতিতে রং-পিচকারি নিয়ে তৈরিই ছিল। রঙের সুনামির সেই ঢেউ আমাদের বাসের দিকেও ধেয়ে এল। প্রবীণ মুরব্বির সাদা পাঞ্জাবিটা একমুহূর্তেই লাল-সবুজ-নীল-হলুদ। তিন সেকেন্ড তিনি স্তব্ধ ছিলেন। সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিল, মুরব্বি মনে হয় এবার রেগেমেগে চেতে উঠবেন। কিন্তু না, এরপরই সবাইকে অবাক করে দিয়ে অন্যদের সঙ্গে রীতিমতো নাচে যোগ দিলেন টুপি পরা সেই মুরব্বি। তিনি জানালা দিয়ে চিৎকার করে আরো বলতে লাগলেন, ‘ওই পোলাপাইন! সবাইকেই রং দাও। বেশি করে দাও। আজ বড় খুশির দিন। বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!’ বাসযাত্রীদের নাচের শক্তি তখন আরো বেড়ে গেল।

শুক্রবার আমিও মানিক মিয়াতে বসে বসে বিজয়ের অনুষ্ঠানের কারণে জ্যামে বসেও রাগ করতে পারলাম না। রাগ এলো না। উল্টো সেই মুরব্বির মতো গাড়ির সবাইকে নিয়ে খুশিতে মেতে থাকলাম দীর্ঘ সময়। আমি ঠিক জানি না, অন্য কোনো কারণে এ রকম পৌনে তিন ঘণ্টার জ্যামে বসে থাকলে এমন হাসিখুশি থাকতে পারতাম কি না।

লেখক : সাংবাদিক। বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।