তারার দেশে বাপিদা

Looks like you've blocked notifications!

সময়টা তখন সত্তর দশক। একদল স্বপ্নবাজ তরুণ সংগীত জগতে বিপ্লব আনার প্রচেষ্টায় দিনরাত কাজ করে যাচ্ছিল। সেই প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখে ১৯৭৫ সালে। সাতজন তরুণ মিলে গঠন করে বাংলার প্রথম রক ব্যান্ড। ব্যান্ডের নাম রাখা হয়েছিল সপ্তর্ষি। পরবর্তীতে নাম বদলে রাখা হয় মহীনের ঘোড়াগুলি। এমন ব্যাতিক্রমী নামকরণ করা হয়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘ঘোড়া’র দ্বিতীয় লাইন –‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। জীবনানন্দ  তৎকালীন সময়ের প্রচলিত সাহ্যিতের ধারা ভেঙে আধুনিক বাংলা কবিতার গোড়াপত্তন করেছিলেন এবং বাংলা কবিতার ভাষায় নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি যিনি রবীন্দ্র সাহ্যিতের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে কবিতা রচনা করেছিলেন। জীবনানন্দের হাত ধরেই বাংলা কবিতা নতুন যুগে প্রবেশ করে।

বাংলা সংগীত জগতে এমনই ব্যাতিক্রমী কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডটি। ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়, তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রনজন ঘোষাল, তাপস দাস, এব্রাহাম মজুমদার, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় ও প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। এই ব্যান্ডটি এমন সময় বাংলা সংগীত জগতে প্রবেশ করে যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও বাংলা চলচ্চিত্রের গান জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। সবদিক থেকেই ব্যাতিক্রম ছিল মহীনের ঘোড়াগুলি।

পশ্চিমবঙ্গের গতানুগতিক সংগীতধারার মোড় পাল্টে দিয়েছিল এই ব্যান্ডটি। মহীনের ঘোড়াগুলির গানগুলোকে  কোনো নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা যাবে না। তাদের অনেক গানে বাংলা ফোক সংগীতের প্রভাব যেমন রয়েছে তেমনই কিছু গানে মার্কিন শহুরে ফোক সংগীতের প্রভাবও রয়েছে। মহীনের ঘোড়াগুলি-র ঝুলিতে বাউল গান, লোকসংগীত থেকে শুরু করে রক,পপ,জ্যাজ সব ধরণের গানই রয়েছে। তাদের অনেক জনপ্রিয় গান রয়েছে , যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য-পৃথিবীটা নাকি, তোমায় দিলাম, টেলিফোন, মানুষ চেনা দায়, হায় ভালোবাসা, কিসের এতো তাড়া, সাত তালা বাড়ি, ভালোবসি জ্যোৎস্নায়। মহীনের ঘোড়াগুলি বাণিজ্যিকভাবে সফলতা পায়নি। ১৯৮১ সালে ব্যান্ডটি পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৫ সালে ‘আবার কুড়ি বছর পরে ‘ শিরোনামে একটি অ্যালবাম নিয়ে ফিরে আসে। এবার দুই বাংলায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে তাদের গানগুলো। প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তাদের গানের  জনপ্রিয়তা হারায়নি।

গান না হারালেও গানের স্রষ্টারা একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন। এবার সে তালিকায় যোগ হলেন তাপস দাস। যিনি বাপিদা নামেই বেশি পরিচিত। চলতি বছরের জানুযারি মাসে এই শিল্পীর ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রকাশ্যে  আসে। তিনি অসুস্থ ছিলেন দীর্ঘদিন। অসুস্থতা নিয়েই একাধিক স্টেজ-শো করেছিলেন। অসুস্থতার খবর শোনামাত্রই তার পাশে এসেছিলেন সংগীতশিল্পীরা। চিকিৎসার খরচ জোগাতে তৈরি করা হয় তহবিল। ‘ফসিলস’ ও ‘বর্ণ অনন্য’ ব্যান্ডগুলো চিকিৎসার খরচ তোলার জন্য কনসার্টের আয়োজন করেছিল কলকাতায়। পরে বাপিদার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিল ভারতের রাজ্য সরকার। সবার বিশ্বাস ছিল এবার হয়তো সুস্থ হয়ে বাপিদা ফিরে আসবেন। কিন্ত বাপিদার আর ফেরা হলো না। অনুরাগীদের অর্থ জোগাড়ের চেষ্টা, চিকিৎসকদের চিকিৎসা, সকলের প্রার্থনা সবকিছু ছেড়ে বাপিদা এখন অনেক দূরে চলে গিয়েছেন। মাত্র ৬৮ বছর বয়সেই থেমে গেল বাপিদার পথচলা। বাপিদার মৃত্যুতে গোটা সংগীত জগতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বাপিদা হাজার আলোকবর্ষ দূরের তারা হয়ে গেলেও তার ভক্ত,অনুরাগীরা আজীবন তাকে ম্মরণ করবে তার গানের জন্য।

আনন্দ বাজার, উইকিপিডিয়া,টাইমস অব ইন্ডিয়া অবলম্বনে