ঈদে কেন মানুষ বাড়ি ফেরে?

Looks like you've blocked notifications!

“যান্ত্রিক শহরে বাতাসে বোধহয় মায়ের সুবাস ভাসে,

দু’চারটে গাছেদের পাতায় শিস দেয় বাবার কঠিন ডাক

বন্ধু বলে আর কবে, এবারও নেই ছুটি?

এদিকে আমি ক্যালেন্ডারে যাবার তারিখ টুকি!”

বাঙালির দুটো বড় উৎসব। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ঈদ এলেই একটা বিষয় সবার মনে উঁকি দেয়। কবে মিলবে ঈদের ছুটি, কখন বাড়ি ফিরবে শরীর! শরীর? নয় তো কী? আমরা যেখানেই থাকি, আমাদের মন সবসময় পরিবারের কাছে পড়ে থাকে। নইলে কি ঈদে বাড়ি ফেরার এমন হিড়িক লাগত?

বাড়ি ফিরতে মানুষের কত কষ্ট! ট্রেন, বাস, লঞ্চের ছাদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফেরা কেবল প্রিয়জনকে এক নজর দেখতে। একটু সময় কাটাতে। যে সময়ের কাছে টাকা অর্থহীন, ক্লান্তি অর্থহীন, ঝুঁকিকেও ঝুঁকি মনে হয় না। কর্মব্যস্ত জীবনে সুখ হয়তো আসে। সেইসব সুখের ভেলাতেও আমরা ভেসে যাই মাঝেমধ্যে। কিন্তু আদি ও অকৃত্রিম সুখ, নাড়ির টান আর প্রিয়জনের ঘ্রাণ, তা কেবল বাড়ি ফেরাতেই মেলে।

প্রতিবার ঈদ এলেই দেখতে পাই চেনা দৃশ্য। তিল ধারণের জায়গা থাকে না গণপরিবহনে। অনেক বাড়তি ভাড়া গুণতে হয়। বহুদূরের পথ পাড়ি দিতে টিকেট কাটতে হয় আগে থেকেই। স্টেশনে এসে বসে থাকতে হয় দীর্ঘক্ষণ। তবু, কোনো অভিযোগ নেই। সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে, কখনও বেশি দিয়ে হলেও বাড়ি যাওয়া চাই-ই চাই। জীবন ও জীবিকার চলমান প্রবাহে অনেকে পরিবার নিয়ে শহরে থাকেন। দেখা যায় গ্রামের ভিটেমাটিতে কেউ থাকে না। এরপরেও, ঈদ এলে সেখানেই ছুটে চলা পরিবার নিয়ে। যারা একা থাকেন, মিথ্যে সুখের অভিনয় চালিয়ে যান বারোমাস, তারা ঈদ এলে বাড়ি যান বোধহয় সত্য অসুখটা সারাতে।

এবারের ঈদ পড়েছে ভরা বর্ষায়। বাস, ট্রেন, লঞ্চে; কেউবা মোটরসাইকেলে চড়ে পাড়ি দেন পথ। বৃষ্টিতে ভেজেন, রোদে পোড়েন, ঘর্মাক্ত দেহ বিদ্রোহ করে বসে। কিন্তু, ওই যে মন; সে তো মুক্ত পাখি। এই পথটুকু তার কাছে খাঁচা ছেড়ে কটাদিন স্নিগ্ধ হাওয়ায় উড়ে বেড়ানোর আনন্দ এনে দেয়। ওপাশের স্টেশনে, লঞ্চঘাটে বন্ধুরা অপেক্ষায় থাকে, প্রিয়জন এসে দাঁড়ায়। উষ্ণ আলিঙ্গনে নিমিষে উবে যায় পেছনে ফেলে আসা কয়েকঘন্টার যুদ্ধক্ষেত্র। একেকজন তখন দিগ্বিজয়ের হাসিতে প্রফুল্ল।

এই প্রফুল্লতার স্বাদ আস্বাদন করতেই মূলত মানুষ ঈদে বাড়ি যায়। সবুজ পথ, শ্যাওলা ধরা পুকুর ঘাট, পাড়ার টং, চেনা মুখ, মায়ের হাতের রান্না; কী থাকে না অল্প কদিনের মুক্তিতে? উৎসবকে পূর্ণতা দিতে শূন্যতা ছেড়ে যাওয়াটাও এক প্রকার উৎসব। যাদের প্রিয়জন হারিয়ে গেছেন, তাদের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে  বিদেহী আত্মার জন্য দোয়া করার সুযোগ কেউ কি হারাতে চাইবে? ঈদে প্রতিবার কাউকে হারিয়ে ফেলার শোক, সমান্তরালে নতুন কারও আগমণের সুখ মিলিয়ে তৈরি হয় মিশ্র অনুভূতি। ছোটদের অপেক্ষা, কখন হাতে নতুন নোট আসবে। ঈদ সালামি দিতে হলেও তো বাড়ি যাওয়া চাই নাকি! সালামি নিয়ে করা খুনসুটিগুলো যে চাইলেও পাওয়া যাবে না যান্ত্রিকতা আর কৃত্রিমতায় মোড়া নগর জীবনে।

ঈদে কেন মানুষ বাড়ি ফেরে, তার জবাব আদতে হয় না। এই অনুভূতি হৃদয়ের ততটা গহীন থেকে আসে, যতটা গহীনে শুধুই প্রিয়জনের বাস। যতটা গহীন থেকে কেবল ভেসে আসে, কিছু সম্মোহনী সুরে গাঁথা সুর। সোঁদামাটির গন্ধ গায়ে মেখে, পাখির সঙ্গে কথা বলতে বলতে হারিয়ে যাওয়া পথের পানে তাকিয়ে থাকে এমন এক মায়া, যাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারও নেই।

লেখক : সাংবাদিক