শত বছরের ‘জলযোগ’র লুচি-মিষ্টান্নে আজও সেই আদি-ঐতিহ্য

Looks like you've blocked notifications!

‘খাওয়াটা কিন্তু একটা বড় ধরনের আর্ট।’ বরেণ্য কথাসাহিত্যিক, গল্পকার, রম্যলেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর এই কথা মেনে নেবেন যে কেউ। আর বিশেষ করে আমরা বাঙালিদের কথা তো বলতেই হয়! খাবার-দাবারের সঙ্গে মেহমানদারী আমাদের ঐতিহ্য। রান্নায় স্বাদ জিহ্বায় এনে দেয় জল। সে যে যা-ই বলুক, খেয়েই সেই জল নিবারণ করতে আমরা সদা প্রস্তুত। মেহমান এলে ঘরোয়া রান্নার পাশাপশি জেলার সেরা কী আছে, তা তাকে এনে খাওয়ানো, নিয়ে খাওয়ানোতে পটু বটে। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘রসনা বিলাস’ সবারই মনে আছে নিশ্চয়। সেভাবেই বলতে হয়, ‘তোমরা যে যা বল ভাই, বাঙালির চেয়ে রসনা বিলাসী এ পৃথিবীতে কেউ নাই।’ আর সেই রসনা বিলাসে যদি থাকে যশোরের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান ‘জলযোগ’র সকালে নাস্তা! তাহলে তো কথাই নেই।

যুগ যুগ ধরে তেলে ডোবা গরম লুচি আর নিরামিষের স্বাদ নিতে জলযোগে ছুটে আসেন মানুষ। খেতে চাইলে একটু সময় নিয়েই যেতে হয় সেখানে। আর দাম? সে হাতের নাগালেই। অল্প খরচে এমন স্বাদের খাবারের গল্প ছোটে তাই মুখে-মুখে। যার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে বিদেশেও।

১৮৯৩ সালে অবিভক্ত ভারতের অন্যতম নগরী যশোরের জমিদারের গাঁতিদার ছিলেন কালিপদ বিশ্বাস। এক ফসলের সেই সময় খাজনা আদায়ের দায়িত্ব ছিল তার মূল লক্ষ্য, যা দিয়ে তার বিশাল পরিসরের যৌথ পরিবার চালাতে হিমশিম অবস্থায় পড়তে হতো। আরেকটু সহজ জীবনের বন্দবস্ত করতে শহরের দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন রেল রোডে শুরু করেন সকালের জলখাবার ও চা। সেই থেকে আরও চলছে ‘জলযোগ’। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় আছেন কালিপদ বিশ্বাসের তৃতীয় বংশধর অজিত বিশ্বাসের ছেলে সাধন বিশ্বাস।

সাধন জানান, জলপুরি ও ডালের সুস্বাদু খাবারের পাশাপশি সেখানে আছে রসমালাই, ছানার পোলাও, পানতোয়া, মিহিদানা, কালোজামসহ নানা আয়োজন। মানুষের এসব পছন্দ করে খান। বাপা-ঠাকুরদার এই প্রতিষ্ঠানটি তিনি শুধু ব্যবসা হিসেবে নেননি, তাই দামও রাখেন ক্রেতার হাতের নাগালে। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে যেন আমিও ফিরে গিয়েছিলাম শত বছর আগের সেই যশোরে। সোনালি অতীতের সেই জলযোগে। সময়ের বিবর্তনে খাবার পরিবেশনে কাঁসার থালা বাটির স্থান দখলে নিয়েছে স্টিলের প্লেট গ্লাস। তবে, পরিবর্তন আসেনি ক্রেতার ভিড়ে। ১২ বাই ১৪ ফুটের একটি ছোট্ট দোকান ঘরে নতুন পুরাতন মিলিয়ে চারটি টেবিল ও একটি ক্যাশ কাউন্টার আছে। ঢুকেই ডানপাশে হাত ধোয়ার বেসিন। এরই মধ্যে সকাল-বিকেল খাবারের স্বাদ নিতে আসেন মানুষজন।

জলযোগ প্রসঙ্গে যশোরের বহুল প্রচারিত দৈনিক রানারের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক দিপু আলম স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার বয়স তখন আট বা দশ। বাবার হাত ধরে জলযোগে যেতাম। জলযোগে না খেতে পারলে ভালো লাগত না। তাই সকালে না হলে সন্ধ্যায় একবার না একবার যেতাম। ছাত্র জীবনে আমার একটি দিন বাদ যায়নি যে জলযোগে যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘জলযোগের রসমালাই ছিল আমার সবথেকে প্রিয়। আজ পর্যন্ত এর বিকল্প খুঁজে পায়নি।’

দিপু আলম বলেন, ‘আমি একদিন ঢাকায় গেলাম। আমার এক সদ্য পরিচিত যখন জানলেন আমার বাড়ি যশোর, সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন—আপনি জলযোগ চেনেন? আমি অবাক হলাম, কী বলেন, জলযোগের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক। কথাটুকু বলতেই গর্বে আমার মন ভরে গেল।’ তার দাবি, জলযোগের রসমালাই ও কালো চমচম, মিষ্টির কথা সৌদি, কুয়েত, লিবিয়া, মিশরের অনেকেই এখন জানে।

জলযোগ প্রসঙ্গে বিবর্তন যশোরের সভাপতি নওরোজ আলম খান চপল জানান, বাবার প্রতিশ্রুতিতে জলযোগের নাস্তার লোভে তারা ছোটবেলায় বাবাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়তেন তারা। আরও বলেন, ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে সেখানে নাস্তার আড্ডায় মেতে উঠতেন।

জলযোগের পরিচালক সাধন বিশ্বাস জানান, পুরনোদের মধ্যে এখনও সেখানে তার বাবা অজিত বিশ্বাসের বিসস্ত একজন কর্মচারী আছেন। তার নাম নারায়ণ কুমার। ৫৫ বছর ধরে কাজ করা এই নারায়ণ কুমার জানান, এখানে কাজ করে খুব সহজভাবেই জীবন পার করছেন তিনি। যারা এখানে কাজ করেছেন, তারা কেউ ছেড়ে যেতে চাইতেন না। এক বাবুর্চি সাত বছর বয়সে কাজ শুরু করে আমৃত্যু সেখানেই কর্মরত ছিলেন।

জলযোগে সকালের নাস্তায় থাকে ঝুড়িভর্তি গরম লুচি। প্রতিটির দাম সাত টাকা। সুস্বাদু ছোলার ডালের ঘন্টোর বাটি ১০ টাকা। কখনও কখনও পরিবেশিত হয় সবজি বা আলুর বিশেষ পদ।

এখানে মিষ্টির কেজি প্রতি দাম ৩০০ টাকা এবং সন্দেশ ৪৬০ টাকা, রসগোল্লা ৩০০ টাকা, রসমালাই ৪৮০ টাকা, ছানার পোলাও ৩২০ টাকা, মিহিদানা ৩৬০ টাকা, পানতোয়া ৩২০ টাকা, রাজভোগ ৩০০ টাকা, ছোট চমচম ২৮০ টাকা, ছোট কালোজাম ২৮০ টাকা ও টক দই ১৪০ টাকা।