বড়দিন শেখায় সম্প্রীতি

Looks like you've blocked notifications!

২৫ ডিসেম্বর, শুভ বড়দিন। খ্রিস্টধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। খ্রিস্টানপ্রধান ইউরোপজুড়ে অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে উদযাপন করা হয় দিনটি। তবে, অসাম্প্রদায়িক বাংলায়ও সাড়ম্বরে এই উদযাপনটায় থাকে অন্যরকম রঙে আঁকা আলাদা একটি প্রাণ। এ অঞ্চলের গির্জায়-গিজায় বয়ে যায় বাংলার সুরলহরী। কেউ গাইতে থাকে—‘সুন্দর এই পুণ্য রাত/উজল তারার আলোয় ভরা পুণ্য রাত...জেগে থাকো তুমি, জেগে থাকো’, আবার কেউ গাইতে থাকে, ‘প্রভু জিশুর চরণ ধরে ওরে ভোলামন/ ওই চরণ না ভজিলে যে বৃথা যাবে জীবন।’ এমন সব ক্যারোল বা আনন্দের স্তবগানের পাশাপাশি নানা আয়োজনে মেতে থাকে গির্জাসহ খ্রিস্টধর্মালম্বীদের ঘর, আঙিনা।

ক্রিসমাচ বাংলায় ‘বড়দিন’ হয়ে ওঠোর ইতিহাসটি আলোচনাসাপেক্ষ। তবে, কবি ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্তের বেশ কিছু কবিতায় আছে এই দিনের কথা। আর সেই কবিতাগুলো জানান দেয়, এই বাংলার বহু আগের অসাম্প্রদায়িকতা কতটা মধুর। বড়দিন ঘিরে ‘বড়দিন’ শিরোনামের কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘যদিও আমরা হই হিন্দুর সন্তান। বড়দিনে সুখি তবু, খৃষ্টান সমান।’ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল তার ‘বিষের বাঁশি’ কাব্যগ্রন্থের ‘সত্য-মন্ত্র’ কবিতায় লিখেছেন, ‘চিনেছিলেন খ্রীষ্ট বুদ্ধ/কৃষ্ণ মোহাম্মদ ও রাম/মানুষ কী আর কী তার দাম।’ প্রলয়-শিখা কাব্যের ‘নমষ্কার’ কবিতায় লিখেছেন, ‘তব কলভাষে খল খল হাসে বোবা ধরণীর শিশু,/ ওগো পবিত্রা, কূলে কূলে তব কোলে দোলে নব যিশু।’ ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার ‘বড়দিন’ শিরোনামের কবিতায় বলেছেন স্বার্থহীন ভালবাসার কথা। লিখেছেন—‘তাই তোমার জন্মদিনের নাম দিয়েছি আমরা বড়দিন,/স্মরণে যার হয় বড় প্রাণ, হয় মহীয়ান চিত্ত স্বার্থহীন।/আমরা তোমায় ভালবাসি, ভক্তি করি আমরা অখৃষ্টান,/তোমার সঙ্গে যোগ যে আছে এই এশিয়ার, আছে নাড়ির টান।’ সেই যিশুকে কেন্দ্র করে বড়দিনে ক্রিসমাসে কেক, আলো, ক্রিসমাস ট্রি না হলে খ্রিস্টীয় উত্‍সব যেমন সম্পন্ন হয় না, তেমন এই উত্‍সবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ক্যারোল।

যিশুর জন্ম সঙ্গীতের সঙ্গে পালিত হয়েছিল বলে মনে করেন অনেকে। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর রোমে প্রাচীনতম বিশেষ খ্রিস্টমাস স্তোত্রবন্দনাগুলোর রচনা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে ক্যারোল মধ্যযুগীয় কর্ড প্যাটার্নে সুরারোপিত। এই কারণে এই গানগুলির সুর বেশ স্বতন্ত্র ধরনের হয়ে থাকে। ঘুরেফিরে আনন্দের স্তবগান এখন আরও আধুনিক, আরও মধুর।

এদিনের অন্যতম আকর্ষণ লাল রঙের পোশাক, চোঙা আকৃতির লম্বা টুপি পরা সাদা চুল-দাড়িওয়ালা সান্তা ক্লজ। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কিংবদন্তি চরিত্রটির সেই সেন্ট নিকোলাস নামের ধর্মযাজক শিশুদের মন রাঙিয়ে রাখেন। যদিও ইতিহাসের দয়ালু এই সেন্ট নিকোলাস এমন কোনো পোশাক পরিধান করেননি। তবে, তার মহানুভবতা সবার মাঝে বাসা বাঁধে বড়দিনে নতুন করে।

খ্রিস্টবিশ্বাস অনুসারে, এই বস্তুজগতে মানবজাতির জন্য সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের সবচেয়ে বড় উপহার হলো যিশুখ্রিস্ট। পৃথিবীতে তার আবির্ভাব শান্তি, একতা, মিলন ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠায়। আর তাই এই মহান পরিত্রাণকর্তার জন্মক্ষণ তথা বড়দিন উপলক্ষে সমগ্র বিশ্বের খ্রিস্টবিশ্বাসীরা মুক্তি আর মিলনের আনন্দে মেতে ওঠে।

বড়দিনের ঐতিহ্য খ্রিস্টীয়দের প্রতি ঈশ্বরের প্রেম ও অনুগ্রহের প্রতীক। যিশুর জন্মদিন বিশেষ ধরনের পূজা, গান, নৃত্য, ও চেয়ারিটির কাজের মাধ্যমে উৎযাপিত হয়। দিনটিতে মানুষের মধ্যে সদগুণের বাণী বেশি বেশি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দিনটিতে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, স্বার্থপরতার অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আহ্বান করা হয় মানুষকে।

বড়দিনে পরিবারের সদস্য, স্বজন ও প্রতিবেশিদের মধ্যে ভালোবাসার ও সম্পর্ককে আরও শক্ত সুতোয় বেঁধে দেয়। এদিনে দাতব্যকাজ করে থাকেন অনেকে। এই উৎসবের সময় অনেকে গরিব, অসুস্থদের অনুদান দেন। ফলে বন্ধন ছড়িয়ে পরে শ্রেণিবিবেধ ভেঙে।

যিশু নিজে যন্ত্রণাময় ক্রুশীয় মৃত্যু ধারণ করে মানবজাতিকে মুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন। তাই অবক্ষয়ে আকীর্ণ মানবতার মুক্তির জন্য ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় সেই চিরায়ত উক্তি, ‘লেট দেয়ার বি লাইট’।

বড়দিন আমাদের প্রেমের শিক্ষা দেয়। বড়দিন আমাদের পরিত্রাণের নিশ্চয়তা দেয়। বড়দিন আমাদের বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। বড়দিনের শিক্ষা আমাদের হিংসা-বিদ্বেষ, জুলুম-নির্যাতন পরিহার করতে শেখায়; শান্তি, সম্প্রীতি ও ভালোবাসায় পরস্পর মিলেমিশে বসবাসের অনুপ্রেরণা জোগায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক