বায়ান্নর স্মৃতি

আমার মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : এনটিভি অনলাইন

১৯৫২ সালে আমি ক্লাস ফোরের ছাত্র ছিলাম। গ্রামে স্কুলে গেলাম নিয়ম অনুযায়ী ১০টার দিকে। গিয়ে দেখলাম যে ছাত্ররা কেউ ক্লাসে নেই। এটা আমি ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির কথা বলছি। ২১ ফেব্রুয়ারি তো ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি করা হয়েছে। ছাত্র নিহত হয়েছেন, অনেকে আহত হয়েছেন। প্রতিদিনের মতো ২২ ফেব্রুয়ারি আমি (গ্রাম : পাকুন্দিয়া, জেলা : আগে ময়মনসিংহ ছিল, বর্তমান কিশোরগঞ্জ) গ্রামের স্কুলে গিয়ে দেখলাম যে আমাদের স্কুলের ছাত্র কেউ ক্লাসে যায়নি। ওখানে একটা খুব বড় মাঠ ছিল, মাঠের এক কোনায় একটা বড় জামগাছ ছিল, সেই জামগাছের তলায় সবাই জমা হয়েছে। এর মধ্যে যারা সিনিয়র ছাত্র, মানে যারা ক্লাস নাইন-টেনে পড়ে, তারা এগুলো নিয়ে আলোচনা করছে। তারা বলছে যে ঢাকায় নুরুল আমিনের পুলিশ (নুরুল আমিন তখন মুখ্যমন্ত্রী) গুলি করে ছাত্র মেরে ফেলেছে। তার প্রতিবাদে আমরা ক্লাস করব না। আমরা স্ট্রাইক করব। স্ট্রাইক কী? কী নয়? এগুলো সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না।

যাই হোক, সেদিন ক্লাস হলো না। তখন নানা কথা আলোচনার মধ্যে ওই সাব-ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার থেকে দুজন ছাত্র এলেন। আসার পরে তাঁরা বক্তৃতা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঢাকায় আন্দোলনে গুলি, ছাত্র নিহত হওয়া—এসব ঘটনা বললেন। এবং এ ঘটনার প্রতিবাদে আগামীকালও আমরা স্ট্রাইক করব, এ ঘোষণা দিলেন। সেদিনই আমি জীবনের প্রথম মিছিলে যাই আমাদের স্কুল থেকে। ওই থানায় আরো অনেক স্কুল ছিল, সেগুলোতে আমরা মিছিল করে হেঁটে গিয়েছি এবং স্লোগান দিয়েছি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই’, ‘মুসলিম লীগ, মুসলিম লীগ, ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক’। আমার এই স্লোগানগুলোর কথা স্পষ্ট মনে আছে। অন্য দু-তিনটা স্কুল ঘুরে আমরা আবার আমাদের স্কুলে ফিরে আসি। এসে এখান থেকে চারদিকে ছড়িয়ে গেছি।

এ ঘটনাটা তখন আমার মনে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং রাজনীতি সম্পর্কে নানান চিন্তা-চেতনা আমার মনের মধ্যে দেখা দেয়। এর আগে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে আজাদী দিবস, স্বাধীনতা দিবস আমি দেখেছি। অন্য প্রথম স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। তার পরে যেসব অনুষ্ঠান হতো, সেগুলোর তুলনায় এই ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যে প্রতিবাদ, যে উত্তেজনা, রাষ্ট্রভাষার দাবি, সরকার পতনের দাবি, মুসলিম লীগের পরাজয়ের দাবি—এটা আমার মনে বিরাট আলোড়ন তুলেছিল। এবং তখন থেকে আরম্ভ করে ক্রমাগত রাজনীতি বিষয়ে নানা কথা শুনেছি।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন থেকে ২১ দফা কর্মসূচিতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এ রকম বড় নেতাদের তখন আমি দেখি। অনেক ঘটনা। তো, এই যে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা—রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন, সেটা সারা পূর্ব বাংলায়, পূর্ব পাকিস্তানে, আজকের বাংলাদেশে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর, শহর থেকে শহরান্তর সর্বত্রই বিরাটভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং সব মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। কেবল মুসলিম লীগের অল্প কিছু সংখ্যক এটা সমর্থন করেনি। কিন্তু তারাও প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতে সাহস পায়নি। নীরব থেকেছে। এই ভাবে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ সকলের দাবি হয়ে উঠল। তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই অনেকের মনে দ্বিধা ছিল, যদি এখন দেশে আন্দোলন হয়, মুসলিম লীগ সরকার যদি ক্ষমতাচ্যুত হয়, এ রকম অনেক কথাই শুনেছি। তবে এসব কথার চেয়ে অনেক বড় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। এভাবে আমার মধ্যে তো বটেই, সারা দেশে, অর্থাৎ তখনকার পূর্ব বাংলায় মানুষের মধ্যে একটা অত্যন্ত গভীর এবং প্রবল রাজনৈতিক চেতনা দেখা দেয়। যা ক্রমেই বিকশিত হয়েছে। এবং প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হতে হতে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, এরপর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান এঁদের নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আরো অনেক নেতারই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।