৪০ টাকা লবণের চাষি পায় ৪ টাকা, চাষে ভাটা
উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, বাজারে সোডিয়াম সালফেটের প্রভাব ও রেকর্ড পরিমাণ লবণ উদ্বৃত্ত থাকার পরও আমদানির কারণে হতাশ চাষিরা। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে লবণ মৌসুম শুরু হলেও অনেক জায়গায় এখনও চাষিরা মাঠে নামেননি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয় ও লবণ মিল মালিক, ব্যবসায়ী, চাষিদের সূত্র জানা যায়, দাম না পাওয়ায় মাঠ ও মিলে পড়ে রয়েছে সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টন লবণ।
লবণের মৌসুম শেষ না হতেই অন্য বছর চাষিরা জমির মালিকদের হাতে অগ্রিম টাকা দিয়ে দিতেন। কিন্তু এ বছর তার উল্টো। ক্ষেত্রবিশেষে লবণ মাঠ বিনে পয়সায় দিয়েও চাষি মিলছে না। এরই মধ্যে দুইদিন আগে লবণের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে বলে যে অপপ্রচার হয়েছে, তাতে আরেকটি ধাক্কা খেল দেশীয় এই শিল্পটি।
সারা দেশের লবণের চাহিদার সিংহভাগ মেটানো হয় কক্সবাজারের লবণ দিয়ে। বর্তমানে লবণের দাম না পাওয়ায় এখানকার লবণ মাঠ মালিক ও চাষিদের করুণ দশা। সব মিলিয়ে লবণশিল্প করুণ অবস্থার মুখোমুখি।
টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকার লবণ মাঠের মালিক আজম খান বলেন, ‘মৌসুম শেষ না হতেই পরের বছরের জন্য অগ্রিম লাগিয়তের টাকা দিয়ে যেত চাষিরা। এ বছর চাষিদের খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছর যারা চাষ করেছে তারাও অনীহা প্রকাশ করছে।’
সদরের ইসলামপুরের লবণ মাঠের মালিক মনজুর আলম (দাদা) বলেন, ‘অন্য বছরের মতো এ বছর চাষিদের আগ্রহ নেই। দাম না পাওয়ায় সবাই হতাশ। যে লবণের মাঠের লাগিয়ত মূল্য ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ছিল, তা এ বছর অর্ধেক দামেও চাষিরা নিচ্ছে না। কিছু জায়গায় চাষি নামলেও তা কাঙ্ক্ষিত নয়। লবণশিল্প বাঁচাতে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা দরকার।’
বিসিক কক্সবাজারের উপ-মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ আহামদ বলেন, ‘মৌসুম শুরু হলেও বেশিরভাগ এলাকায় এখনও চাষিরা মাঠে নামেনি। ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে চাষিদের আস্থা ফেরানো না গেলে চাষিদের মাঠে নামানো দায় পড়বে।’
ইসলামপুর লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম আজাদ প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘কষ্টে উৎপাদিত ফসলের দাম না পেলে কেন চাষিরা মাঠে নামবে? আগে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। আস্থা ফেরাতে পারলেই এই শিল্পকে রক্ষা করা সম্ভব।’
লবণের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আমদানিকারক সিন্ডিকেট আবারও সক্রিয় হচ্ছে কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে শামসুল আলম আজাদ খতিয়ে দেখা দরকার বলে জানান।
খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, ৮০ কেজির লবণের বস্তা মাঠ পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দরে। সে হিসাবে কেজিতে পড়ছে মাত্র চার টাকা। যা দিয়ে মজুরি বা উৎপাদন খরচও সামাল দিতে পারছেন না চাষিরা। অথচ বাজারে প্যাকেটজাত লবণ কেজিতে বিক্রি করা হয় প্রায় ৪০ টাকা। উৎপাদনের পর থেকে বাজারে পৌঁছা পর্যন্ত অন্তত তিনটি হাত বদল হয়। প্রত্যেক হাতে লাভ পড়ে। কেবল লোকসান সয়েই যেতে হচ্ছে ‘চিরবঞ্চিত’ চাষিদের।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ মৌসুমে বিসিকের চাহিদা ১৮ লাখ ৪৯ হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।
২০১৮-১৯ মৌসুমে কক্সবাজার জেলায় উৎপাদনযোগ্য লবণ জমির পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ৫৯৬ একর। চাষির সংখ্যা ২৯ হাজার ২৮৭ জন। গত মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ লাখ মেট্রিক টন। বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন। যা বিগত ৫৮ বছরের লবণ উৎপাদনের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
লবণ মিল মালিক, ব্যবসায়ী, চাষিদের মতে, দেশে লবণের বাজার স্বাভাবিক রয়েছে। কোনো ধরনের ঘাটতি নাই। বর্তমান যে পরিমাণ লবণ উদ্বৃত্ত রয়েছে তা দিয়ে আরো অন্তত দুই মাস চলবে। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী লবণের সংকট দেখিয়ে দাম বৃদ্ধির অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এর মধ্যে একটা কুচক্রি মহল লবণের কেজি ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে অপপ্রচার চালিয়েছে। তারা মূলত এ শিল্পকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে। অপপ্রচারকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
এদিকে, গত মঙ্গলবার কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সাধারণ সভায় সভাপতি নুরুল কবির বলেছেন, ‘বর্তমানে তাদের হিসেবে তিন লাখ মেট্রিক টনের ওপরে লবণ উদ্বৃত্ত। কিছু মিল মালিকের কারণে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সোডিয়াম সালফেট বাজারে সয়লাব হয়ে গেছে। বন্ড লাইসেন্স, কাস্টিং সল্ট ইত্যাদি নামে লবণ আমদানি করছিল একটা শ্রেণি। আমাদের কঠোরতায় ওই রকম লবণ আমদানি বন্ধ হয়েছে।’
সভাপতি আরো বলেন, ‘লবণের জাতীয় চাহিদা নিরূপণে সবাইকে এক টেবিলে বসতে হবে। আমরা লবণ ব্যবসায়ী ঐক্যবদ্ধ হলে এই শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব। ঘরের সমস্যা ঘরেই সমাধান চাই।’
লবণ মিল মালিকদের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিসিকের অসাধু কর্মকর্তারা কারসাজি করে কালোবাজারিদের সুযোগ করে দেয়। যে কারণে বারবার দেশীয় লবণ শিল্প মার খাচ্ছে। উদ্বৃত্ত থাকার পরও প্রতি বছর লবণ আমদানি করা হয়। ট্যাক্স ফ্রি সোডিয়াম সালফেট ছড়িয়ে দিচ্ছে বাজারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা দেশে ২৪ থেকে ২৫ লাখ মেট্রিক টন চাহিদা দেখিয়ে লবণ আমাদানির অনুমতির জন্য গত ১৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলেন। অথচ দেশে লবণের চাহিদা সর্বোচ্চ ১৮ লাখ মেট্রিক টন।
লবণ মিল মালিক, ব্যবসায়ী, চাষিসহ সংশ্লিষ্টদের দাবি, দেশীয় লবণশিল্প বাঁচাতে সমস্ত লবণ আমদানি বন্ধ করতে হবে। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে না পারলে মাঠে ফেরানো যাবে না চাষিদের। লবণের পরনির্ভর হবে দেশ, বাড়বে বেকারত্ব। সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে যারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট, সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি করে তাদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে।