বাজেট উচ্চাভিলাসী হওয়া প্রয়োজন : অর্থমন্ত্রী
বাজেটে ব্যবসায়ীর কথা যেমন ভাবতে হয়, তেমনি দরিদ্র চাষির কথাও ভাবতে হয় বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, ‘সবার কথা ভাবতে হয় বলে বাজেট উচ্চাভিলাষী প্রয়োজন। এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’
আগামী অর্থবছরের (২০১৬-১৭) বাজেট নিয়ে এনটিভি ও এফবিসিআইয়ের বিশেষ আয়োজন ‘কেমন বাজেট চাই’ অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। আজ শুক্রবার রাত ৮টা ১০ মিনিট থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে এ অনুষ্ঠান চলে।
টানা নবমবারের মতো এনটিভি ও এফবিসিসিআই এই অনুষ্ঠান আয়োজন করল।
রাজধানীর প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল, চট্টগ্রামের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও নিউইয়র্কের এনটিভি স্টুডিও থেকে এ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করে এনটিভি।
অনুষ্ঠানে প্যানেলে উপস্থিত থেকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের প্রশ্নের জবাব দেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ।
প্যানেল আলোচনায় আরো ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানও প্যানেলে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে এনটিভির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী উপস্থিত ছিলেন।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘দশম বাজেট দিচ্ছি, এটা আমার জন্য সৌভাগ্যের। আমার অপূর্ণ ইচ্ছা থাকে, যা ধরাছোঁয়ার মধ্যে আসে না, সেটা করার চেষ্টা করি। বাজেটে যেমন ব্যবসায়ীর কথা যেমন ভাবতে হয়, তেমনি দরিদ্র চাষির কথাও ভাবতে হয়। আমি উচ্চাভিলাষী বাজেট দিতে পছন্দ করি। সেই বাজেটের সুফল আমরা পাচ্ছি।’
‘আগামী বাজেট আগের মতোই হবে। তবে কিছু প্রজেক্ট যোগ হবে। এখন আটটি মেগা প্রজেক্ট আছে, এই সরকারের সময়ে আরো হয়তো দু-তিনটি মেগা প্রজেক্ট হবে। এসব নিয়ে আলাদা একটি বিষয় বাজেটে উল্লেখ থাকবে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আামি বারবার বলি, আমি সুদের হার নির্ধারণ করি না। আপনারাই সুদের হার বাড়িয়েছেন-কমিয়েছেন। তবে আমরা অন্যভাবে সাহায্য করতে পারি। আমার বিশ্বাস আপাতত এটা এখানেই থাকবে। তবে এটা কমবে। আগামী দুই বছর আমাদের বিনিয়োগের জন্য সুবর্ণ সময়। সেটা কাজে লাগাতে হবে।’
বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘সরকার ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে খবুই যত্নবান। আমরা বাস্তববাদী, সেই আলোকেই বাজেট হবে। এবারের বাজেটে সবাই খুশি হবে বলে আমার বিশ্বাস।’
‘সরকার ক্ষমতায় আসার সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল তিন হাজার মেগাওয়াট, এখন আমরা ১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রাখি। আমরা সেই বাংলাদেশ, যারা একদিন খাদ্য ঘাটতিতে ছিলাম, এখন আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’
‘বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করেছে। গার্মেন্টস সেক্টর ২৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করবে। গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের অনেক সুযোগ আমরা দিয়েছি।’
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে কাজ করে যাচ্ছি। এর ফল আগামীতে পাওয়া যাবে।’
ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন বাণিজ্যমন্ত্রী। বেসিসের সভাপতি শামীম আহসানের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনলাইনে সব কিচু করার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স খবরদারি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। রানা প্লাজার পরে আর তেমন কোনো ঘটনা ঘটছে না। ব্যবসায়ীরা এখন এসব ব্যাপারে যত্নবান।’
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ভ্যাট নিয়ে অর্থমন্ত্রী এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না, যাতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে।’
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে উদ্ধৃত করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘সামাজিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
‘আমরা ১০৭টি দেশে ফার্মা প্রোডাক্ট রপ্তানি করি। আগামীতে এটা আরো বাড়বে। নানা খাতে আমরা প্রণোদনা দিচ্ছি। দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করাই হবে বাজেটের একটি লক্ষ্য। কাগজ শিল্পে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। সিমেন্ট শিল্প ভালো করছে। তারা রপ্তানি বাড়াচ্ছে।’
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্প বা বাজেট প্রণয়ন যত সুষ্ঠুই হোক না কেন, বাস্তবায়ন নিয়ে তৈরি হয় সমস্যা। ঢাকা-চট্টগ্রাম বা ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেনের দিকে তাকালেই সেটি বোঝা যাবে।’
‘বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিবেশের কথাও ভাবতে হবে। বিশেষত জ্বালানি খাতে বিনিযোগের ক্ষেত্রে। রামপাল বা বাঁশখালী থেকে সেই অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনী খাতে টাকার আনুপাতিক হার বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাড়াতে হবে, এটা বাজেটের আনুপাতিক হারে বাড়াতে হবে।’
‘রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক খাতের সমস্যা দূরে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেটা দেখতে চাই।’
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘বড় প্রকল্প নিয়ে সার্বিক মূল্যায়ন আরো বাড়ানো দরকার। বড় প্রকল্প নিয়ে আরো আলোচনা হওয়া দরকার। তারপরই অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা উচিত। জ্বালানি নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। এই বাজেট থেকেই তার সূচনা হোক।’
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, মধ্য আয়ের উপযোগী দেশের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবতে হবে।
বিজিএমইএ সভাপতির বক্তব্য
তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘বাজেট হওয়া উচিত উৎপাদনবান্ধব ও জনবান্ধব। রানা প্লাজার পর যে মন্দা ছিল, সেটি কাটছে। শুধু প্রবৃদ্ধি বাড়ালে হবে না। কর্মসংস্থানও বাড়াতে হবে।’
‘গত দুই বছর গার্মেন্টস সেক্টরে বিনিয়োগ কম হয়েছে। কর্মসংস্থান কম হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা মাত্র চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাই।’
অন্যান্য ব্যবসায়ীর প্রশ্ন ও বক্তব্য
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘তেলের বাজার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।’
উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট সেলিমা আহমাদ বলেন, ‘ট্যাক্স ও ভ্যাট যেন এমন না হয় যাতে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।’ ভ্যাট না বাড়ানোর প্রত্যাশা করেন তিনি।
ব্যবসায়ী টিটো বলেন, ‘৬৪ জেলায় চেম্বারের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দ রাখা হচ্ছে কি? সেটা নিয়ে ভাবা উচিত।’
নিজামউদ্দিন টিটো বলেন, ‘টেলিকম সেক্টরে আমরা ২২ বছর আমদানিনির্ভর ছিলাম। এখন এখানে মোবাইল উৎপাদন হবে। এ ক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে ট্যাক্স হলি ডে চাই।’
বেসিসের সভাপতি শামীম আহসান বলেন, ‘এই যুগে প্রযুক্তির দিকে বেশি নজর দেওয়া উচিত। সরকারি কার্যালয়ে ফাইল চালানোর ক্ষেত্রে ডিজিটাল হতে হবে।’
নারী উদ্যোক্তা প্রতিমা চক্রবর্তী বলেন, ‘বাজেটে জৈবকৃষির ব্যাপারে উদ্যোগ থাকা উচিত। নিরাপদ ও সুস্থ খাদ্য উৎপাদনের জন্য বাজেটে জৈবকৃষি নিয়ে বরাদ্দ রাখা উচিত।’
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আলহাজ আবদুস সালাম বলেন, ‘বাজেটের কারণে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এটা যেন না হয়।’
কৃষকদের ভাষ্য, ধান বা চাল যেন কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনা হয়। উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম দাবি করেন তাঁরা। এ জন্য তাঁরা বিদ্যুৎ, সার আর কীটনাশকের দাম কমানোর কথা বলেন। সরকারি সহায়তা সব কৃষক যেন পায় সে জন্য ব্যবস্থাপনা চান তাঁরা।
চট্টগ্রামের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার থেকে
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুব আলম বলেন, ‘থিংক বিগ। বড় কিছু চিন্তা করলে বড় কিছু আসবে। বড় কিছু চিন্তা না করলে বড় সাফল্য আসে না।’
‘এলএনজির জন্য চট্টগ্রামের বিনিয়োগ পিছিয়ে আছে। সেটার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এখানে ক্ষুদ্র বিনিযোগ ভালো। ঢাকা-চট্টগ্রাম আট লাইন হলে ব্যবসা আরো ভালো হবে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য আলাদা বাজেট চাই।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের বন্দর দুই মিলিয়ন ক্লাবে চলে গেছে। এখানে একটি বে টার্মিনাল দরকার। বিমানবন্দরের পরিধি বাড়ানো দরকার।’
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘ডাবল ডিজিটের প্রবৃদ্ধির জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স স্বেচ্ছাচারিতা করছে। তাদের কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের বিদেশি খবরদারি কোথাও নেই। এদের ওপর খবরদারি করার ব্যবস্থা করতে হবে।’
চট্টগ্রাম জুনিয়ার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট জসিম উদ্দিন তরুণদের জন্য কোনো নীতিমালা থাকবে কি না তা জানতে চান।
তিনি বলেন, ‘সরকার যদি চামড়ার চেয়ে জুতাশিল্পের দিকে নজর দেয় তাহলে উপকার হব।’
নিউইয়র্ক স্টুডিও
নিউইয়র্ক স্টুডিওতে অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন আবিদুর রহমান টিপু।
ওই স্টুডিওতে উপস্থিত ইউএনের সিনিয়র ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এসডিজি বাস্তবায়নে বাজেটে যদি উল্লেখযোগ্য দিকনির্দেশনা থাকে, তাহলে ভালো হবে। এখানে কিন্তু এবার কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রেমিটেন্সের পরিমাণ যাতে আরো বাড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানো ব্যবস্থা আরো উন্নত করতে হবে।’
নিউজার্সির রাটগার্স বিজনেস স্কুলের ফিন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকসের শিক্ষক ড. মাহমুদ হাসান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনেক। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের প্রশংসা হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে নিতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিযোগ বাড়াতে হবে। ব্যাংকের ঋণের সুদ কমাতে হবে।’