সরকারের ভেতরেই সিন্ডিকেট?
নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেট এখন সবার জানা৷ ভোজ্য তেল, চাল, পেঁয়াজ, ডিম, চাল, ব্রয়লার মুরগির পর সর্বশেষ হলো ডাব সিন্ডিকেট৷ আর ইলিশের এই ভরা মৌসুমেও মাছের উচ্চমূল্যের পেছনে আছে সিন্ডিকেট৷
ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘ডাবের অস্বাভাবিক দাম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা বিস্মিত হই৷ কারণ, আমদানি পণ্য বা আরও কিছু পণ্যের নিয়ন্ত্রণ কিছু সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের হাতে আছে৷ কিন্তু, ডাবের ব্যবসা তো করেন হাজার হাজার হাজার ব্যবসায়ী৷ এখানে কীভাবে সিন্ডিকেট সম্ভব! এখানে যেটা হয়েছে ব্যবসায়ীদের অসৎ মানসিকতা৷ ডেঙ্গুর অজুহাত তুলে তারা যে যার মতো ডাবের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ ব্যবসায়ীদের মধ্যে এখন যে অসৎ মানসিকতা ঢুকে গেছে, সেটা নিয়ন্ত্রণ খুবই কঠিন৷ তারা সব সময় দাম বাড়ানোর অজুহাত খুঁজতে থাকেন৷’
‘এখন আমরা ইলিশ নিয়ে কাজ করছি৷ বোঝার চেষ্টা করছি, ভরা মৌসুমেও দাম কেন এত বেশি? আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি৷ অভিযান চালানোর আগে আমরা তথ্য নিয়ে যাচাই করি৷ এখানেও একই পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি’, যোগ করেন এ এইচ এম সফিকুজ্জামান৷
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘বড় বড় সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ এখন যেকোনো পর্যায়ে সিন্ডিকেট হয়৷ সেটা স্থানীয়, আঞ্চলিক সবখানেই৷ এখানে ক্ষুদ্র আর বড় ব্যবসায়ী এখন আর বিষয় নয়৷ যে যেভাবে পারে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে ফেলে৷’
এ পর্যন্ত ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ, চাল, ডিম, ব্রয়লার মুরগিসহ আরও কিছু পণ্যের শক্তিশালী সিন্ডিকেট চিহ্নিত হয়েছে৷ যেমন ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ছয়-সাতটি প্রতিষ্ঠান, চাল ২০টি প্রতিষ্ঠান, ব্রয়লার মুরগি-ডিম পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠান৷ তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে৷ তাদের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিদপ্তর এবং প্রতিযোগিতা কমিশন মামলাও করেছে৷ কিন্তু, কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না৷
প্রধানমন্ত্রী এই সিন্ডিকেট নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন, বাণিজ্যমন্ত্রী আসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন৷ আর শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বলেছেন, ‘অর্থনীতি ও বাজার দুই জায়গাতেই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে৷ যার কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে৷’
কামাল আহমেদ মজুমদার আরও বলেন, ‘মন্ত্রীদের ভেতরেই সিন্ডিকেট আছে৷ শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িতরা মন্ত্রী৷’ এই কথা বলে অবশ্য কামাল আহমেদ মজুমদার অন্য মন্ত্রীদের তোপের মুখে পড়ে চুপ হয়ে গেছেন৷
ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘ভোগ্যপণ্য ও কৃষিপণ্যে বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ ঢুকে বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে৷’
সিন্ডিকেট কারা?
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) হিসাব বলছে, বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে ১৮২ জনই ব্যবসায়ী, যা ৬২ শতাংশ৷ আর এই ব্যবসায়ীদের আবার আওয়ামী লীগের মহাজোট থেকে নির্বাচিত হলেন ১৭৪ জন, যা ৬০ দশমিক ৪১ শতাংশ৷
কনজ্যুমারস অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘বেশ কয়েকজন মন্ত্রীও আছেন যারা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত৷ তাদের চালসহ ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা আছে৷ আর ব্যবসায়ী এমপিতো অনেক৷ ফলে তারা সবাই মিলে নিজেদের অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থই দেখে৷’
এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘এর বাইরে আরও যারা প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আছেন, তারা ওই মন্ত্রী-এমপিদেরই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব৷ তারা সরকার ও প্রশাসনে অনেক প্রভাবশালী। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না৷ ব্যবস্থা নেওয়া হয় না৷ সরকারের মধ্যেই সিন্ডিকেট থাকলে, যা হয় তাই হচ্ছে৷’
একই কথা বলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ৷ তিনি বলেন, ‘এটা তো ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রিত সরকার৷ তাই, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে টুকটাক কথা হলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি৷ এই সরকার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে বলেও মনে হয় না৷ কারণ, সরকারের মধ্যেই সিন্ডিকেট ঢুকে গেছে৷ সরকারে ব্যবসায়ীদের প্রভাব যতদিন থাকবে, ততদিন সিন্ডিকেটও থাকবে৷’
ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘সিন্ডিকেট আছে৷ তাদের আমরা চিহ্নিতও করেছি৷ সরকারের কাছে সে ব্যাপারে বিস্তারিত প্রতিবেদনও দিয়েছি৷ কিন্তু, আমরা ভোক্তা অধিকার আইনে সব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারি না৷ আমরা সাধারণত ভোক্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিই৷ সিন্ডিকেট, মজুদতদারীর বিরুদ্ধে আইন আছে, বিশেষ ক্ষমতা আইন আছে৷ কর্তৃপক্ষ চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারে৷ আমাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা কমিশন ৭৬টি মামলা করেছে৷ ডিমের ক্ষেত্রে আটটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷’
কেন আইন প্রয়োগ হয় না?
ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯ সালের৷ আর প্রতিযোগিতা কমিশন আইন ২০১২ সালের৷ ভোক্তা আইনে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড আর অনূর্ধ্ব দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে৷ আর প্রতিযোগিতা আইনে সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান আছে৷ তবে, এই আইন সাধারণত খুচরা বিক্রেতাদের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করতে দেখা যায়৷ সিন্ডিকেট, মজুতদারদের বিরুদ্ধে নয়৷
আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে এসব মজুতদার, কালোবাজারি, সিন্ডিকেটবাজদের ধরতেই ওই আইন করেছিলেন৷ এই আইনে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান আছে৷ কিন্তু, এই আইনটি প্রয়োগ করা হচ্ছে না বাজার সিন্ডিকেটকারীদের বিরুদ্ধে৷ মনে হয় যেন আইনটি আর নেই৷’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করলে ওই ব্যবসায়ীদের কারাগারে যেতে হবে৷ সেটা হলে তো অনেকেই বিপদে পড়বেন৷ যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের সঙ্গেই তো এই ব্যবসায়ীরা আছেন৷ তাদেরকে তো সবাই চেনেন৷ সরকার চেনে৷’
আর নাজের হোসেন বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখি না৷ এর কারণ হলো এই সরকার ব্যবসায়ী বান্ধব৷ তারা জনবান্ধব নয়৷’
ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আমাদের টার্গেট থাকে ভোগ্যপণ্যের সাপ্লাই চেইন যাতে বিঘ্নিত না হয়৷ তাই আমাদের আইনে যে ব্যবস্থা আছে, তা-ও অনেক সময় প্রয়োগ না করে আমরা ব্যবসায়ীদের মোটিভেটেড করার চেষ্টা করি৷’