ব্যাংকের স্পর্শকাতর তথ্য প্রকাশে নারাজ গভর্নর, থাকবে প্রবেশে কড়াকড়ি
বাংলাদেশ ব্যাংকে অবাধে প্রবেশ করতে পারছেন না সাংবাদিকরা। মার্চের শুরু থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশে নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে উঠেছে অভিযোগ। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফায় আলোচনা হয়েছে সাংবাদিকদের। কিন্তু কোনো সমাধানে আসতে পারেনি কেউ। ফলে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালন।
এদিকে, ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের স্পর্শকাতর তথ্য বেরিয়ে আসায় সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশের এই কড়াকড়ি এখনই তোলা যাবে না বললেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গতকাল বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) এক বৈঠকে অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) নেতাদের একথা জানালেন গভর্নর নিজেই। তবে আশার কথা শোনালেন এই যে, ব্যাংকে প্রবেশের কড়াকড়ি শিথিলের বিষয়ে আগামী ৮মের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন তিনি। আর তখন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিবেন।
সাংবাদিকদের জন্য আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে অবাধ যাতায়াত ছিল জানিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সিঁড়িতে বিক্ষুব্ধ সাংবাদিকরা বলেন, ‘বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এতে আমাদের তথ্য পাওয়ার অধিকার পুরোপুরি লঙ্ঘন হচ্ছে।’ ব্যাংকে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপে গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেন, ‘বর্তমানে আমরা পাস ইস্যুর মাধ্যমে ব্যাংকের শুধু নির্দিষ্ট কর্মকর্তার কাছে যেতে পারছি। এর বাইরে অন্য কোনো কর্মকর্তার কাছে যেতে আমাদের নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এমনকি দেখা করতে যাওয়া কর্মকর্তাও নানা জবাবদিহিতার মধ্যে পড়ছেন। অনেককে হয়রানিতেও পড়তে হচ্ছে। তাই ইচ্ছা থাকলেও এখন আর কোনো ব্যাংক কর্মকর্তা আমাদের সাথে দেখা করতে চায় না। এতে আমাদের তথ্য পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে আমাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন চরম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’
তবে ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কোন বাধা নেই জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন স্পর্শকাতর তথ্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় ব্যাংক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর হতে হয়েছে। ব্যাংকে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের একটা নিয়মের মধ্যে চলতে হবে। সেটা হলো সাংবাদিকরা ব্যাংকের নির্দিষ্ট অনুমতিপত্র নিয়ে শুধু মুখপাত্রের কাছে যেতে পারবেন। অন্য কর্মকর্তার সঙ্গে দেখার করার ক্ষেত্রে লাগবে সেই কর্মকর্তার সম্মতি। এখন যদি কেউ (কর্মকর্তা) সম্মতি না দেয়, তবে সেই ক্ষেত্রে কোনোক্রমেই তার সাথে দেখা করতে পাস পাবেন না ।
অবাধে প্রবেশ বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মৃধা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম ব্যাংকে প্রবেশ সংক্রান্ত জটিলতা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপরও বিষয়টির সমাধান হয়নি। মিলেনি ব্যাংকে অবাধে প্রবেশের স্বাধীনতা। বরং শুনে এসেছেন ব্যাংকে অবাধে প্রবেশ হরণের অসংখ্যা ব্যাখ্যা।
বৈঠক শেষে ইআরএফ সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মৃধা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা নেই। তবে বর্তমানে ব্যাংকে প্রবেশে কড়াকড়ি অবস্থানে আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব নিয়ে গভর্নরের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। গভর্নর বলেছেন কড়াকড়ি এই মুহূর্তে তোলা যাবে না। তারা (বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ) ৮ মের পর ব্যাংক বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। কীভাবে আগের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকে অবাধে প্রবেশ করা যায়, সেই বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে সাংবাদিকরা ব্যাংকের নির্দিষ্ট অনুমতিপত্র নিয়ে শুধু মুখপাত্রের কাছে যেতে পারবেন। তবে কোনো কর্মকর্তা যদি সাংবাদিকদের পাস দেন, সেক্ষেত্রে তারা শুধু সেই কর্মকর্তার কাছে যেতে পারবেন। তবে আগের মতো তারা অবাধে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বিভাগে প্রবেশ করতে পারবেন না।’
বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে গণমাধ্যমে এক লিখিত বিবৃতি দেন ইআরএফ। সেই বিবৃতি বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্টারদের নির্বিঘ্ন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার দাবি নিয়ে বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মৃধা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম গভর্নরের সঙ্গে সভা করেছেন। সেখানে ইআরএফের পক্ষ থেকে তথ্য সংগ্রহের স্বার্থে রিপোর্টারদের আগের মতো বাধাহীনভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল কর্মকর্তার কাছে যাতায়াতের অধিকার গতকাল থেকেই নিশ্চিত করতে গভর্নরকে জোরালোভাবে অনুরোধ করা হয়েছে।
ইআরএফের নেতারা বলেছেন, গত ৫৩ বছর ধরে রিপোর্টাররা অবাধে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। এতে কখনো তাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। হঠাৎ করে রিপোর্টারদের প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করায় ব্যাংক খাত নিয়ে ভুল রিপোর্টিং হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে, যা কোন পক্ষেরই কাম্য নয়। এসময় গভর্নর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন টপসিক্রেট ডকুমেন্টস নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় ব্যাংক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক খাতের বিভিন্ন তথ্যের স্পর্শকাতরতা ও মার্জার বিষয়ে রিপোর্টারদের নিয়ে দুটি কর্মশালা আয়োজনের প্রস্তাব দেয় ইআরএফ।
আগামী ৮ মের পরে ব্যাংক খাতের স্পর্শকাতরতা নিয়ে কর্মশালাটি আয়োজন করতে গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্রকে তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। মার্জার বিষয়ে পরবর্তীতে কর্মশালা আয়োজন করা হবে বলে জানান গভর্নর। তবে ইআরএফের একমাত্র দাবি অনুযায়ী বরাবরের মতো রিপোর্টারদের বাংলাদেশ ব্যাংকে অবাধ যাতায়াতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন গভর্নর। তিনি বলেন, সাংবাদিকরা যে কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে চান, ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে পাস নিয়ে ঢুকতে হবে। এছাড়া, সাংবাদিকরা পাস নিয়ে মুখপাত্রের কাছে যেতে পারবেন। তবে ইআরএফ নেতাদের তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে, কর্মশালা আয়োজনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিপোর্টারদের অবাধ যাতায়াতের বিষয়টি বিবেচনা করবেন তিনি।
সার্বিক পরিস্থিতিতে রিপোর্টারদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাধাহীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে করণীয় নির্ধারণে ইআরএফের সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মৃধার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ইআরএফ পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।