বিদেশি ঋণ ১১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা, উদ্বেগ অর্থনীতিবিদদের
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছে বাংলাদেশের দেনার পরিমাণ এখন ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে) এ ঋণের পরিমাণ ১১ লাখ ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ১৫ বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ বিলিয়ন ডলার। গত ১৫ বছরে দেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৭৭ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩৪২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে বিদেশি ঋণের এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
গত ডিসেম্বর মাসে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এসব বিদেশি ঋণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদসহ সুশীল সমাজের নাগরিকরা। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে। এছাড়াও বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ কয়েকটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকেও ঋণ নিয়েছে। এসব ঋণের ৭৯ শতাংশই নিয়েছে সরকার এবং বাকি ২১ শতাংশ ঋণ নিয়েছে বেসরকারি খাত।
বিদেশি এসব ঋণের বেশির ভাগই ব্যবহার করা হচ্ছে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে। এরমধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, ঢাকা মেট্রোরেল (লাইন-৬), হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প। রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন উৎস থেকে বড় প্রকল্পে কঠিন শর্তে নেওয়া ওই সব ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়ও এসে গেছে। এতে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’র (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, সরকার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে নতুন করে আবার ঋণ করছে। এতে দেশ দীর্ঘমেয়াদি ঋণের চক্রে পড়ে যাচ্ছে এবং বিদেশি ঋণ পরিশোধে ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে।
সম্প্রতি রাজধানীর একটি মিলনায়তনে উপস্থাপিত ‘বাংলাদেশের সরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ এবং পরিশোধের সক্ষমতা : উদ্বেগের কারণ’ শীর্ষক প্রবন্ধে ড. মোস্তাফিজুর রহমান উল্লেখ করেছেন, গত ডিসেম্বর মাস শেষে সরকারি–বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ সরকারি ঋণ এবং ২০ শতাংশের মতো বেসরকারি খাতের ঋণ। গত তিন অর্থবছরের বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারকে ২৪ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা ঋণ করতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও প্রায় ১৫ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা ঋণ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, ঋণ করে বড় প্রকল্প করলে ২০-৩০ শতাংশ খরচ বেড়ে যায়। এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনা বড় ইস্যু হয়ে যায়।
একই অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতারণামূলক বাস্তবতার মধ্যে আছি। ঋণ নিয়ে এত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে এর প্রতিফলন নেই। মানুষের গড় আয়ু কমেছে, মৃত্যুহার বেড়েছে। আবার বেকারের সংখ্যাও বেড়েছে। ২৫ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করে চলতে হয়। গত দেড় দশকে এত কিছু করলাম; তাহলে মানুষ এসবের সুফল পেল না কেন?’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘ব্যাংকের টাকা ফেরত দেওয়া হয় না। শেয়ারবাজারের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের টাকা লুটপাট হয়েছে। বৈদেশিক ঋণে মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পুঁজি সঞ্চয়ের নতুন উৎস হিসেবে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতে তা বেশি হয়েছে। আমার বিশ্বাস, মেগা প্রকল্পের সঙ্গে ওই বিশেষ গোষ্ঠীর টাকা পাচারের সংশ্লেষ পাওয়া যাবে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন গত বৃহস্পতিবার (২ মে) ঢাকায় ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ, ব্যাংক একীভূত করা, টাকা ও ডলারের সংকট, বৈষম্য, মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘যখন ঋণ খেলাপিওয়ালা বেশি বড় হয়ে যায়, তখন এক হাজার টাকা কৃষিঋণের কারণে কেউ জেলে যায়, আর ১০ হাজার কোটি টাকা শিল্পঋণের খেলাপি গ্রাহক সরকারের পাশে বসে। এখন যে যত বেশি শক্তিমান, সে তত বড় খেলাপি। তার সুদ মওকুফও হয় তত বেশি।’
ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘ঋণখেলাপি, করখেলাপি ও অর্থ পাচারকারী এক সূত্রে গাঁথা।’ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর আরও বলেন, ‘বেসিক ব্যাংককে যতই একীভূত করা হোক, সেটা ভালো হবে না।’