ব্যাংক খাতে ‘সুশাসন’ ফেরানোর চেষ্টায় বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশে ডুবতে যাওয়া ব্যাংক খাতে আশার আলো দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে টাস্কফের্স গঠন, কমপক্ষে এক ডজন ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, দখলদারদের হাত থেকে ব্যাংক উদ্ধার এবং কাগুজে নোট ছেপে ব্যাংকের তারল্য সংকট না কমানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ফল দেবে বলে মনে করছেন তারা।
তবে অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংকের এখনো তারল্য সংকট আছে। ব্যাংক থেকে টাকা তোলার সিলিং তুলে দেওয়া হলেও এখনো কোনো কোনো ব্যাংক বড় অংকের চেকে টাকা দিতে পারছে না বলে অভিযোগ আছে।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর অর্থ উপদেষ্টা করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদকে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করা হয় অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকার ড. আহসান এইচ মনসুরকে। দুজনই ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের কথা, তারা যে উদ্যোগ এরই মধ্যে নিয়েছেন তা অব্যাহত থাকলে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরে আসবে আর সুশাসন ফিরে এলে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা কাটবে, গ্রাহকের আস্থা ফিরে পাবে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা সাতটি ব্যাংক ‘উদ্ধার’ করেছে। ওই সাতটি ব্যাংকসহ মোট ১২টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউসিবি, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এর বাইরেও আরো কিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হবে বলে জানা গেছে। এইসব ব্যাংক আসলে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের পরিচালনা পর্ষদ দিয়ে চলতো। এস আলম ছয়টি ব্যাংক থেকে ঋণের নামে ৯৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এর পরিমাণ আরো বেশি হতে পারে।
দেশের মোট ৫৪টি ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে গত সরকারের আমলেই ৩৮টি ব্যাংককে ‘দুর্বল ব্যাংক’ বলে চিহ্নিত করা হয়। সেই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল করার কাজও করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকদের অর্থ না তুলে সবল ব্যাংকে না রাখতে। তাহলে ওই ব্যাংকগুলো আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। তিনি গ্রাহকদের আমানতের নিশ্চয়তাও দিয়েছেন। আর সবল ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে, দুর্বল ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্যের আমানত রাখতে। তাদের তারল্যের একটি অংশ যদি দুর্বল ব্যাংকগুলো পায়, তাহলে তারাও সবল হয়ে উঠবে। ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক সংস্কার কমিশন না করে টাস্কফোর্স গঠন করার কারণে ব্যাংক সংস্কার দ্রুত গতিতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নুরুল আমিন বলেন, “মোট তিনটি টাস্কফোর্সের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালী করা, বাণিজ্যিক ব্যাংক শক্তিশালী করা ও খেলাপি ঋণ বিষয়ক এবং আরেকটি হলো বণিজ্যিক ব্যাংক পুনর্গঠন। ফলে আমি সূচনাটা বেশ ভালো দেখছি। আশা করছি এর মাধ্যমে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরে আসবে।”
ব্যাংক খাত নিয়ে শ্বেতপত্রও প্রকাশ করা হবে। টাস্কফোর্স আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি, মন্দ সম্পদ, প্রধান ঝুঁকিগুলো নিরূপণ করবে। এ ছাড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক পর্যালোচনা, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি নিরূপণ, তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নিট মূলধন নির্ণয়, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ সম্পদকে পৃথকীকরণ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
তবে ব্যাংকার নুরুল মো. নুরুল আমিন বলেন, “টাস্কফোর্সগুলোর প্রতিবেদন পাওয়া গেলে ব্যাংক খাতের সর্বিক পরিস্থিতি পরিষ্কার হবে।”
ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যার একটি হলো খেলাপি ঋণ। দেশে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর খেলাপি ঋণগ্রস্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠানকেও আর ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। আর নানা কৌশলে ঋণ অবলোপন বা খেলাপি তালিকার বাইরে থেকে ঋণ নেয়াও বন্ধ করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হেলালউদ্দিন বলেন, “এখন খেলাপি ঋণ আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ফুটোগুলো বন্ধ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওইসব ফুটো দিয়ে যে হাজার হাজার কোটি টাকা বের হয়ে গেছে, তা উদ্ধার করতে হবে। দেশের বাইরে ওই অর্থ পাচার হয়েছে। তা-ও ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্র, রাজনৈতিক প্রভাব দূর করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এর সুফল পেতে আরো সময় লাগবে।”
আর বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “ব্যাংক খাতে মূল কাজ হলো আস্থা ফিরিয়ে আনা, এই খাতে লুটপাট বন্ধ করা, একই সঙ্গে ব্যাংক খাত পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত না করা। বাংলাদেশ ব্যাংক যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে তার মাধ্যমে আস্থা ফিরে আসবে বলে মনে করি। এরপর ধাপে ধাপে আরো সংস্কারের কাজ করতে হবে। ব্যাংক খাতে পুরোপুরি সুশাসন দরকার।”
বাংলাদেশ ব্যাংক আর টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করবে না। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি কমার আশা করা হচ্ছে। ব্যাংকের সুদের হারও বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে আন্তব্যাংক লেনদেনের সুদের হার। বাংলাদেশ ব্যাংক আর সরাসরি সরকারকে ঋণ দেবে না। সরকারকে ঋণ নিতে হলে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে আর টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিতে হবে না। এর ফলেও মুদ্রাস্ফীতি কমবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
মো. নুরুল আমিন মনে করেন, “চেষ্টা অব্যাহত থাকলে পাচারের সব অর্থ ফেরত আনা সম্ভব।”