ফল প্রকাশের পরদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পান ড. অরুণ কুমার বসাক
বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী ও বাংলাদেশে পদার্থবিজ্ঞানে একমাত্র ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার বসাক। তিনি বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কর্মরত।
অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাকের এসএসসি পরীক্ষার ফল আশানুরূপ হয়নি। যদিও থেমে যাওয়ার পাত্র তিনি ছিলেন না। ১৯৫৭ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৯ সালে ইন্টারমিডিয়েটে রাজশাহী বোর্ডের সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বিতীয় হন তিনি। অধ্যাপক বসাকের কাছে এই রেজাল্ট অবিশ্বাস্য ছিল। গণিত পরীক্ষার দিন এক সহপাঠী তাঁর খাতা দেখে লিখছিল। কেন্দ্র পরিদর্শক পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা আগে অধ্যাপক বসাকের খাতা কেড়ে নিয়ে সাফ জানিয়ে দেন, তাঁকে বহিষ্কার করা হলো। ভয়ে তাঁর দ্বিতীয় পত্রও খারাপ হলো। খারাপ পরীক্ষা দিয়েও যে স্ট্যান্ড করবেন, ভাবতে পারেননি।
পরীক্ষার ফলের দিন তিনি রীতিমতো অবাক হয়ে যান। স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘রেজাল্ট যখন দেখতে গিয়েছি, নিচের দিক থেকেই দেখেছি কোথাও আমার নাম নেই। ভাবলাম, ফেল করেছি। হঠাৎ শুনি, একজন খুব জোরে জোরে নাম পড়ছে। শুনলাম আমি দ্বিতীয় হয়েছি। শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সেই রোল নম্বরটি এখনো মনে আছে ৩৪২০। আমি ভেবেছিলাম, ওরা বোধ হয় ভুল করেছে আমার রেজাল্টে। পরে জানলাম, সেই ইনভিজিলেটরকে আমাদের ইংরেজি বিভাগের হেড আবদুল কাদের বুঝিয়েছিলেন, আমি যেহেতু দোষ করিনি, তাই আমার বিরুদ্ধে যেন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়। না হয় আমার রেজাল্ট বোধ হয় স্থগিত হয়ে যেত।’
তারপর ১৯৬৯ সালে রাজশাহী কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। জীবনে তাঁকে আর ভাবতে হয়নি। রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৬১ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করে স্নাতক শেষ করেন। তখন স্নাতক কোর্স ছিল দুই বছরের। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। স্নাতকোত্তরেও তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন।
মাস্টার্স পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পরদিনই অরুণ কুমার বসাক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ পান। তাঁর জীবনের বৃহত্তর অধ্যায় শুরু হয়েছিল এখান থেকেই।
কর্মজীবন শুরুর বিষয়ে অরুণ কুমার বসাক বলেন, ‘ফাইনালের আগে আহমদ হোসেন স্যার একটা ফরম দিয়ে ফিলআপ করতে বললেন। তখনো আমার মাস্টার্স পরীক্ষা হয়নি। স্যার ওই অংশটুকু খালি রেখে ফরমটা পূরণ করতে বললেন। তিনি জানিয়ে রাখেন, যেদিন রেজাল্ট প্রকাশ হবে, তার পরদিন আমাকে ক্লাস নিতে হবে। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে যেদিন রেজাল্ট প্রকাশ হলো, সত্যি তার পরদিন স্যার নিয়োগপত্র আমার হাতে দিলেন। মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার পরদিন থেকে আমার শিক্ষকতা জীবন শুরু হলো।’
ইন্টারমিডিয়েটে স্ট্যান্ড করার পর থেকেই অধ্যাপক বসাকের ধারণা হয়েছিল, তাঁকে শিক্ষক হতে হবে। দেশ-বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন এ প্রাজ্ঞজন। দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসার টানে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন অধ্যাপক বসাক। বলেন, ‘বার্মিংহামে চাকরির এক বছর পর মনে হলো, বিদেশে কেন থাকব? বাংলাদেশের জন্য আমার কিছু দায়িত্ব আছে। তাই দেশে ফিরে এসেছি।’
তাঁর সারা জীবন কেটেছে পদার্থবিজ্ঞানের সাধনায়। জীবনসায়াহ্নে এসেও তাঁর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় এতটুকুও কমেনি। তিনি এই বয়সেও সারা দিন ল্যাবে থাকেন। সকাল ৯টায় ল্যাবে আসেন, বাসায় ফিরে যান সন্ধ্যায়। শুক্র-শনিবারও তিনি ল্যাবে আসা বাদ দেন না। এখনো তিনি নিজেকে একজন বৃদ্ধ ছাত্র মনে করেন।
তরুণদের উদ্দেশে অরুণ কুমার বসাক বলেন, ‘পড়াশোনার বিয়য়বস্তু উপলব্ধি করার দায়িত্ব নিজের। শিক্ষকেরা জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে দেবেন। ছাত্রদের অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে। মুখস্থ না করে বুঝে বুঝে পড়তে হবে। এতে সময় বেশি লাগলেও উপকৃত হবে। শিক্ষার্থীদের মুক্তমনা হতে হবে। মুক্তমন মানুষকে মহান করে তোলে।’
মুখস্থ না করে বুঝে পড়ার বিকল্প নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ফল বেড়েছে; কিন্তু আগের মতো সেই মান নেই। আমাদের শিক্ষার্থীরা অন্য দেশের তুলনায় মেধায় পিছিয়ে নেই, কিন্তু সঠিক শিক্ষা ও গবেষণার অভাবে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। এই অবস্থার পরিবর্তন আবশ্যক। অনেক ছাত্র বলে, তারা পড়া মনে রাখতে পারে না, ভুলে যায়। আমি তাদের বলব, ভুলে গেলে কোনো সমস্যা নেই। ভুলে যাওয়ার পর যতটুকু মনে থাকবে, সেটাই জ্ঞান।’