শাবিপ্রবির যে স্থাপনায় মুগ্ধ সবাই
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও রয়েছে অসংখ্য শহীদ মিনার। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে প্রাণ উৎস্বর্গকারী শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে এসব শহীদ মিনার। ভাষার মাসের ২১ তারিখ অর্থ্যাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস। এদিন ভাষা আন্দোলনে শহীদদের সম্মানে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। সেই সঙ্গে ফুটে ওঠে শহীদ মিনারের আসল সৌন্দর্য। আর সারাদেশের শহীদ মিনারগুলোর মধ্যে অন্যতম স্থাপত্য হিসেবে জায়গা করে আছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) টিলাবেষ্টিত শহীদ মিনার।
দেশের শহীদ মিনারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু স্থানে নির্মিত শহীদ মিনার হিসেবে পরিচিত শাবিপ্রবির শহীত মিনার। উদ্ভাবন, গবেষণা আর সাফল্যে শাবিপ্রবি যেমন অনন্য তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও অপরূপ। শহরের কোলাহল আর যান্ত্রিকতা থেকে দূরে প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা এ ক্যাম্পাস শিক্ষা, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যশৈলীতে বহন করছে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবের চিহ্ন। এমন নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ নিদর্শন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীসহ দর্শনার্থীদের প্রধান আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এই শহীদ মিনার। শিক্ষার্থীসহ দর্শনার্থীদের আড্ডা, গান আর কবিতায় নিয়মিত প্রাণবন্ত থাকে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তন ও ইউনিভার্সিটি সেন্টারের পাশ ঘিরে ৫৮ ফুট উঁচু টিলার ওপর ছয় হাজার ৮৮৬ বর্গফুট জায়গা নিয়ে নির্মিত সিলেটের অন্যতম এই স্থাপত্য কীর্তি।
সমতল ভূমি থেকে শহীদ মিনারের বেদিতে উঠতে পার হতে হয় ১০১টি সিঁড়ি। যা মোট তিনটি ধাপে বিভক্ত। সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠতেই চোখে পড়বে সৌন্দর্যবর্ধিত বৃত্তাকার দেয়াল। আর শহীদ মিনারের মূল বেদিতে ওঠার জন্য আরও সাত ধাপের ছোট সিঁড়ি পার হতে হয়। এখান থেকে অবলোকন করা যায় পুরো ক্যাম্পাসকে। মানসিক প্রফুল্লতার সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় বীর শহীদদের আত্মত্যাগের কথা, জাগ্রত করে দেশপ্রেম।
শহীদ মিনারের নান্দনিকতা সর্ম্পকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী তাসনূভা নুজহাত বলেন, ক্যাম্পাসে প্রবেশের পর দর্শনার্থীদের প্রধান আকর্ষণ এই শহীদ মিনার। ছাত্র-ছাত্রী ও দর্শনার্থীদের আড্ডা, গান ও কবিতায় নিয়মিত প্রাণবন্ত থাকে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। ক্যাম্পাসে আসলে অন্তত একবার হলেও এখানে আসা হয়। এখানে আসলে অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করে।
শহীদদের স্মৃতি স্মরণ করে রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ইমন শাহরিয়ার বলেন, মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভাষাশহীদদের ত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখার নিমিত্তে নির্মিত শহীদ মিনার বাঙালির জীবনে এক ঐক্য ও প্রেরণার বাতিঘর। শহীদ মিনার অন্যায়, শাসন, শোষণ ও নিষ্পেষণের অবসানের প্রতীক। যা সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশের কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়।
১৯৯১ সালের ১ ফাল্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক যাত্রা শুরু হলেও ওই বছর ক্যাম্পাসে নিজস্ব শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়নি। সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষা দিবস পালন করত। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯২ সালে ছোট-বড় গোল আকৃতির তিনটি স্তম্ভ দ্বারা একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শহীদ মিনার নির্মিত হওয়ার পূর্বে এখানেই জাতীয় দিবসগুলোতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
পরবর্তীতে ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন জাতীয় সংসদের স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বর্তমান শহীদ মিনারটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেই বছর সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে এই শহীদ মিনার নির্মাণ হয়। শহীদ মিনারটির নকশা ও নির্মাণ করেন স্থপতি মহিউদ্দিন খান।
সবুজ সমারোহে নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি দ্বারা আচ্ছাদিত পুরো শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। সবুজ টিলায় উঁচু উঁচু বৃক্ষের ডালপালার আচ্ছাদনে বর্ণিল হয়ে উঠেছে স্থানটি। ওপর থেকে দেখতে বৃত্তাকার হওয়ায় সবুজের মাঝে লাল শহীদ মিনারটিকে মনে হয় জাতীয় পতাকার লাল বৃত্ত।
শহীদ মিনারের সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. কবির হোসেন বলেন, শাবিপ্রবির শহীদ মিনার স্থাপনের ইতিহাস অনেক গর্বের। শুরুতে টিলার পাদদেশে অবস্থিত শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া হতো। পরবর্তীতে এই শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়। ভাষার মর্যাদা রক্ষায় শহীদদের অবদান সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে তুলে ধরতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বদা সচেতন।