যে শহর ধরে রেখেছে বর্ণবাদের ইতিহাস

ইতিহাসের জটিল আবর্তে পড়ে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। তবে মাঝে মাঝে এমন কিছু নমুনা থেকে যায় যা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় অতীতের কথা। এমন এক শহরের কথাই আজ জানাব তোমাদের। যে শহর ধরে রেখেছে একটি দেশের ন্যক্কারজনক ইতিহাসের ছায়া।
দক্ষিণ আফ্রিকার সেই নির্দয় বর্ণবাদের কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৯০-এর দশকের প্রথমভাগ পর্যন্ত আফ্রিকার এই গোটা দেশ ছিল এক ভয়াবহ নিপীড়নের কেন্দ্র।
দক্ষিণ আফ্রিকার সিংহভাগ মানুষই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ এবং তারা ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করত না। সব সুখ আহ্লাদই ছিল শেতাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে।
দক্ষিণ আফ্রিকার শেতাঙ্গরা হলো ডাচ অধিবাসীদের বংশধর, যারা দক্ষিণ আফ্রিকায় বসত শুরু করে ১৭ শতকের দিক থেকে। পরে নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে বহু বছরের আন্দোলন আর রক্তক্ষয়ের পর দেশটি ঝেড়ে ফেলে নিজের বর্ণবাদী চরিত্র। বিশ্বের মানুষের কাছে আদর্শ আর সাম্যের অপর নাম হয়ে ওঠে রংধনু দেশটি।
কিন্তু বর্ণবাদ কি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে ? উত্তরটি হবে, না। বিস্ময়কর শোনালেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে বর্ণবাদ বিলুপ্তির পরও দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি শহর রয়ে গেছে, যা শুধুই শেতাঙ্গদের জন্য বরাদ্দ। সেখানকার অধিবাসীরা সবাই শেতাঙ্গ, কোনো কৃষ্ণবর্ণের মানুষ সেখানে থাকতে পারে না। শহরটির নাম ওরেনিয়া। এ খবর জানিয়েছে বিবিসি।
দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যভাগে, নর্থ কেপ প্রদেশের বিস্তৃত কারু মরুভূমির মাঝে অরেঞ্জ নদীর তীরে অবস্থিত এই ওরেনিয়া এখনো ধরে রেখেছে শেতাঙ্গ শাসিত দক্ষিণ আফ্রিকার স্মৃতি। ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত মাত্র হাজারখানেক অধিবাসীর এই শহরের সবাই শেতাঙ্গ শাসিত দক্ষিণ আফ্রিকাকে বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর।
কোনো কৃষ্ণাঙ্গ অথবা মিশ্র বর্ণের কাউকে এই শহরে থাকা তো দূরের কথা, প্রবেশ করার অনুমতিও দেওয়া হয় না। শহরের প্রশাসন থেকে শুরু করে মজুরের কাজও করে এখানকার বাসিন্দারা। নেহাত দরকার না পড়লে বাইরে থেকে কাউকে আসতে দেওয়া হয় না এখানে।
শহরের বাসিন্দাদের মুখপাত্র ক্যারোল বিশফের মতে, ‘সবাই দক্ষিণ আফ্রিকার পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে পারেনি। তাই আমরা এই শহর গড়ে তুলেছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য আমাদের পরিচয় আর ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা।’
ওরেনিয়াতে নেই কোনো পুলিশ অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সেখানে নেই বললেই চলে। ওরেনিয়ার আছে নিজস্ব মুদ্রা, ‘ওরা’। শহরটির রকমসকম দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন পরিচয়ের সাথে খাপ না খেলেও সরকার কিন্তু ওরেনিয়ার অধিবাসীদের একেবারেই ঘাটায় না। এমনকি তারা ইতিমধ্যে স্বায়ত্ত্বশাসনের ব্যাপারে দেনদরবার শুরু করেছে। শহরটির অধিবাসী হতে হলে শেতাঙ্গদেরও রীতিমতো শহরের হর্তাকর্তাদের বিশেষ কমিটির ছাড়পত্র নিতে হয়।
এখন নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন জাগবে এই শহরের ব্যাপারে অন্যদের মতামত কী? সুখের কথা হলো এই উদ্ভট শহরটির ব্যাপারে কেউই বিশেষ সহানুভূতিশীল না। শিকাগো ট্রিবিউওনের মতে, ‘ওরেনিয়া হলো পরাজিত শাসক গোষ্ঠীর শেষ করুণ আশ্রয়।’
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্টের মতে, ‘শহরটি হলো বর্ণবাদের শেষ ঘাটি।’
খোদ আফ্রিকার শেতাঙ্গরা পর্যন্ত এ রকম অতীতে পড়ে থাকার প্রচেষ্টাকে বিশেষ পছন্দের দৃষ্টিতে দেখে না। যদিও ওরেনিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আফ্রিকার অনেক শেতাঙ্গকেই আকৃষ্ট করেছে, কেননা দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য অঞ্চলগুলোতে নিরাপত্তা নিয়ে অনেকে শঙ্কিত।