বাংলাদেশের বিলুপ্ত বন্য প্রাণীরা

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বন উজাড়, শিকার ইত্যাদি কারণে বিশ্বে প্রায় প্রতিদিনই অন্তত ডজনখানেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আর এই বিলুপ্তির ধারা থেকে ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশও।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই আয়তনে ক্ষুদ্র হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে একসময় পাওয়া যেত নানা ধরনের বন্য প্রাণী। এসব প্রাণীর অনেকটিই আজ বেঁচে আছে শুধুই লৌকিক গল্পগাথায়। অধ্যাপক গাজী আসমতের ‘বাংলাদেশের বিলুপ্ত বন্য প্রাণী’ এবং আইইউসিএন-এর রেড ডাটা বুক অবলম্বনে এমন কিছু বিলুপ্ত প্রাণীর কথাই শোনা যাক।
গন্ডার
এশিয়া মহাদেশে যে তিন রকমের গন্ডার এখনো দেখা যায়, সেই ভারতীয়, সুমাত্রান আর জাভাদেশীয় গন্ডারের তিনটি প্রজাতি একসময় বহুল পরিচিত ছিল আমাদের দেশে। সিলেট অঞ্চলে দেখা যেত ভারতীয় প্রজাতিটি। সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিনে পাওয়া যেত অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের সুমাত্রান ও জাভাদেশীয় গন্ডার।
গন্ডারের শিং, মাংস আর চামড়ার বাজারদর বরাবরই খুব চড়া ছিল, ফলে শিকারিদের কাছে এর চাহিদাও ছিল বেশি। ব্রিটিশ ও দেশি শিকারির উপদ্রব আর বন উজাড়ের কারণে খুব সম্ভবত গত শতাব্দীর শুরুর দিকে এ দেশ থেকে এই বিশাল প্রাণী হারিয়ে যায়। সুন্দরবন অঞ্চলে এখনো ‘গন্ডারখালী’, ‘গন্ডারমারা’ প্রভৃতি নামের গ্রাম রয়েছে, যা থেকে এই প্রাণীর বিস্তৃতি সম্বন্ধে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
গৌর/বনগরু
পার্বত্য চট্টগ্রাম আর ঢাকা বিভাগের উত্তরে বাস করত গৌর বা বন্য গরু। গৃহপালিত গরুর এই পূর্বপুরুষরা আকার-আকৃতিতে বিশাল, প্রায় ছয় ফুট উঁচু এবং তদানুপাতে লম্বা। মাংসের লোভে মানুষের নির্বিচারে শিকারের কারণেই বিলুপ্ত হয়ে যায় বন্য গরু। খুব সম্ভবত বাংলাদেশের শেষ গৌরটিকে শিকার করা হয় ১৯৭১ সালে, টেকনাফের জঙ্গলে। এর পরও মাঝেমধ্যে ভারত থেকে কিছু গৌর পথ ভুলে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তবে স্থায়ী বসতি আর কখনই গড়ে ওঠেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে অবশ্য এখনো গৌর ও গৃহপালিত গরুর শংকর ‘গয়াল’ নামক এক ধরনের আধাবুনো গরু দেখা যায়।
বন্য মহিষ
গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪০-এর দশকেও সুন্দরবন অঞ্চলে বন্য মহিষ দেখা যেত। কাদা পানিতে থাকতে এরা পছন্দ করত। সুন্দরবনে বন্য মহিষের প্রাচুর্যের কারণে কিছু গ্রামের নামকরণ হয়েছে বয়ারডাঙ্গা, বয়ারগাতি, বায়ারশিঙ্গে প্রভৃতি নামে (বন্য মহিষকে ‘বয়ার’ ডাকা হতো)। শিকার আর গৃহপালিত পশু থেকে ছড়ানো মারাত্মক সব রোগের প্রাদুর্ভাবে এরা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ময়ূর
অনিন্দ্যসুন্দর এই পাখি একসময় উত্তরবঙ্গ আর ভাওয়াল মধুপুরের গড়ে দেখা যেত। কিন্তু নির্বিচারে শিকারের ফলে অনেকটা অজান্তেই হারিয়ে গেছে এরা বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে। বহুদিন পর্যন্ত গবেষকদের ধারণা ছিল, ঢাকার ভাওয়ালের জঙ্গলে এখনো কিছু ময়ূর টিকে থাকতে পারে। কিন্তু পরে খোঁজখবর করে দেখা যায়, ১৯৮০-এর দিকেই এরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ময়ূরের আরেক জ্ঞাতি সবুজ ময়ূর বা বর্মী ময়ূর ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ অরণ্যে টিকে ছিল, কিন্তু এরাও পরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। সম্প্রতি অবশ্য সরকার ভারত থেকে আমদানীকৃত ময়ূর মধুপুরের শালবনে অবমুক্ত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
হাড়গিলা
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাখি হিসেবে পরিচিত হলেও দুঃখের কথা হলো, প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগেই এই পাখি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। শবখেকো এই বিশালদেহী পাখিগুলো দেখতে কদাকার, পালকহীন গলায় বিশাল চামড়ার ঝুলি ঝুলে থাকে। সাধারণত ময়লা ফেলার ভাগাড়ে এদের দেখা যেত। মূলত মাংসের কারণেই এদের শিকার করা হতো। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিক থেকেই এরা একরকমের বিলুপ্তির পথে চলে যায় অবাধ শিকারের কারণে।
জলার কুমির
নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের নদীনালা থেকে শুরু করে বদ্ধ জলাঞ্চলেও প্রচুর পরিমাণে দেখা যেত এই সরীসৃপগুলো। ১৩ থেকে ১৬ ফুট লম্বা এই কুমিরগুলো কিন্তু সচরাচর মানুষকে আক্রমণ করত না, কিন্তু মানুষ তা বুঝলে তো! কিছুটা ভয়ে, সেই সঙ্গে পরে কুমিরের চামড়ার রমরমা ব্যবসার কারণে মানুষ এদের মেরে শেষ করে দিয়েছে। বাংলাদেশে জলার এই কুমিরের শেষ বংশধর ছিল বাগেরহাটের খানজাহান আলীর পুকুরের প্রসিদ্ধ কুমিরগুলো। দেশের অন্যত্র পঞ্চাশের দশকের পর থেকেই এদের আর দেখা যায় না।
জলার হরিণ/বারশিঙ্গা
এই হরিণদের শিঙ্গে মোট ১২টি শাখা-প্রশাখা থাকে, ফলে নাম হয়েছে বারশিঙ্গা। সিলেট-চট্টগ্রামের জঙ্গলের পাশাপাশি সুন্দরবনের জলা অঞ্চলে বিচরণ করে বেড়াত এরা। অনেকে আবার এদের বিস্তৃতি বরিশাল এবং উত্তরবঙ্গেও ছিল বলে দাবি করেন। হলদে বাদামি রঙের এই সুন্দর প্রাণীগুলোর বিলুপ্তির মূলে আছে মাংস, চামড়া ও ফসল রক্ষার জন্য নির্বিচারে শিকার। খুব সম্ভবত ১৯৫৪-এর বন্যার পর এরা এদের শেষ ঘাঁটি সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এ ছাড়া বাংলাদেশে চিতাবাঘ ও আমচিতা, সোনালি বিড়াল ও বন্য কুকুর, সম্বর, কালো ভালুক ও মালয়ী ভালুক প্রভৃতি প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে গবেষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘসময় ধরে চলা অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে দুর্গম ওই অঞ্চলে বিশেষ কোনো জরিপ চালানো সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের দেশে যে হারে বন উজাড় আর অবাধ জমি দখলের প্রবণতা বর্তমান, তাতে করে ওইসব প্রাণীর টিকে থাকার সম্ভাবনা খুব সামান্যই বলা চলে।