যৌন হয়রানি
হাইকোর্টের সাতদফা নির্দেশনা, বাস্তবায়নে বাধা কোথায়
ইভ টিজিং, স্টকিং (অসৎ উদ্দেশ্যে উত্ত্যক্ত) করাকে যৌন হয়রানি হিসেবে বিবেচনা করে আইনের অন্তর্ভুক্ত, প্রতি থানায় পৃথক সেল গঠন করে প্রতিবেদন পেশ এবং সাইবার ক্যাফে মনিটরিংসহ হাইকোর্ট সাত দফা নির্দেশ জারি করা আছে। জনস্বার্থে দায়ের করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি যৌন হয়রানি বন্ধে সাত দফা নির্দেশনাসহ এই রায় প্রদান করেন হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি মো. ইমান আলী ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের বেঞ্চ।
আদালতের দেওয়া রায়ে বলা হয়, ইভ টিজিং শব্দটি অপরাধের মাত্রা হালকা করে দেয়, এর পরিবর্তে সর্বস্তরে যৌন হয়রানি শব্দটি ব্যবহার করতে হবে। এসএমএস, এমএমএস, ফোন ও ইমেইলের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করাও যৌনহয়রানির আওতায় আসবে। প্রতিটি থানায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য একটি করে সেল গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এই সেল প্রতি মাসে জেলার পুলিশ সুপারের (এসপি) কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে।
এ ছাড়া রায়ে সাইবারক্যাফেগুলোকে নিবন্ধিত করার জন্য এবং ১৮ বছরের নিচে কাউকে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে যারা সাইবার সেন্টারে আসবে তাদের পরিচয়পত্র এবং তারা কতক্ষণ কোন সাইটে সার্চ করে সেটি পর্যবেক্ষণ করারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া শিগগিরই সরকারকে ভিকটিম এবং উইটনেস প্রোটেকশন অ্যাক্ট করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এটি না হওয়া পর্যন্ত সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদকে আইন হিসেবে গণ্য করতে হবে।
প্রস্তাবিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর সংশোধনীতে যৌন নির্যাতনের স্থান হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ না রেখে সব সরকারি ও বেসরকারি স্থানকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে।
সব সাইবার ক্যাফের নিবন্ধন ও ব্যবহারকারীর পরিচয় সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যৌন হয়রানির এসব বিষয় আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণলায়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যুব মন্ত্রণালয়ের অধীনে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে যুব সমাজকে যৌন হয়রানি থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা করতে বলা হয় রায়ে।
কিন্তু বিগত বছরে আদালতের সাত দফা নির্দেশনার এক দফাও বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ ব্যাপারে রিটকারি আইনজীবী ফাহিমা নাসরিন মুন্নী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আদালত রায় দেওয়ায় পরও তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় সারা দেশে রায়ের কোনো প্রভাব নেই। অপরাধগুলো আগের মতোই ঘটে চলছে। তিনি বলেন, এটি সত্যি দুঃখজনক।
রায় বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘রায়ের পর আমাদের মন্ত্রণালয় সব প্রক্রিয়া শেষ করে বাস্তবায়নের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠিয়েছে। তারা এটির বাস্তবায়ন নিয়ে কী করেছে তা আমার জানা নেই।’
সারা দেশে যৌন হয়রানি রোধে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষে জনস্বার্থে অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নী ২০১০ সালের ২ নভেম্বর একটি রিট দায়ের করেন। দীর্ঘদিন শুনানির পর আদালত কয়েক দফা নির্দেশনাসহ রায় প্রদান করেন।
এর আগে ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট কর্মস্থল এবং শিক্ষাঙ্গনে নারী ও শিশুদের যৌনহয়রানি প্রতিরোধের জন্য দিকনির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থে রিট দায়ের করেন বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী।
এ রিট আবেদনের শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট একটি রায় দেন। এ রায়ে বিভিন্নভাবে যৌন নিপীড়নকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞায় হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, শারীরিক ও মানসিক যেকোনো ধরনের নির্যাতনই যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। ইমেইল, এসএমএস, টেলিফোনে বিড়ম্বনা, পর্নগ্রাফি, যেকোনো ধরনের চিত্র, অশালীন উক্তিসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সুন্দরী বলাও যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। শুধু কর্মস্থল কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এ ধরনের হয়রানি ঘটে না, রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের অশালীন উক্তি, কটূক্তি করা, কারো দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো প্রভৃতি যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য করা হবে। রায়ে বলা হয়, কোনো নারীকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন, যেকোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করা, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন, অশালীন চিত্র দেয়াল লিখন, আপত্তিকর কিছু করাও যৌনহয়রানির মধ্যে পড়ে। হাইকোর্টের এ নির্দেশে উল্লেখিত আচরণগুলো সবই দণ্ডবিধির ২৯৪, ৩৫৪ও ৫০৯ ধারায় বর্ণিত আছে। ইভ টিজিং আর যৌন হয়রানি একই অপরাধের আওতায় বিচার হতে বাধা নেই হাইকোর্টের রায়ে। তবে রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় নারীরা যৌনহয়রানির শিকার হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। গত পয়লা বৈশাখ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় একাধিক নারী ইভ টিজিংয়ের শিকার হন।