খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ বছরে পদার্পণ
সেশনজট ও রাজনীতি মুক্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সুনামের সঙ্গে ৩৩ বছর পূর্ণ করে আজ শনিবার (২৫ নভেম্বর) ৩৪ বছরে পদার্পণ করেছে। নানান কর্মসূচিতে উৎসবমুখর পরিবেশ ও বর্ণিল সাজে আজ ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ পালিত হচ্ছে।
‘শিখুন, নেতৃত্ব দিন ও বাঁচুন’ এই স্লোগান এবং নতুন ভিশন, মিশন ও রিসার্চ স্ট্র্যাটেজি প্ল্যান নতুন করে নির্ধারণ করে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা উপাচার্যের।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৮৭ সালের ৪ জানুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসংক্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্ত গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালের ৯ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালের ২৫ নভেম্বর চারটি বিভাগে ৮০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একটি দুতলা ভবনে শিক্ষা কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সেই থেকে ২৫ নভেম্বর ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি যথাযথভাবে পালনের জন্য এ বছর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল বা অনুষদের সংখ্যা আটটি এবং বিভাগের সংখ্যা ২৯টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি। তাদের মধ্যে ৩৪ জন বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন পাঁচ শতাধিক। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ছয়টি সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থীকে আনুষ্ঠানিকভাবে সনদপত্র প্রদান করা হয়েছে।
শিক্ষা কার্যক্রম চালুর পর গত ৩৩ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উল্লেখযোগ্য কোনো সংঘর্ষ, হানাহানি বা রক্তপাত হয়নি। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে এই দীর্ঘ সময়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। দেশে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজট, সন্ত্রাস ও রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বতন্ত্র ভাবমূর্তি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নবম। খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের গল্লামারী এলাকায় স্থাপিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেই মনে হবে এক শান্ত ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। নেই কোনো কোলাহল, নেই শব্দদূষণ। বিশেষভাবে চোখে পড়বে একই রঙে রাঙানো ভবনগুলোর দেয়াল। প্রশাসনিক বা একাডেমিকসহ কোনো ভবনের গায়ে চিকামারা নেই। নেই কোনো স্লোগান লেখা, নেই কোনো ব্যানার ও ফেস্টুন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি ভবনের নাম বিধৃত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শহিদ তথা বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নামে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রবেশদ্বার দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেই প্রথম চোখে পড়বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুউচ্চ ম্যুরাল, যার গায়ে উৎকীর্ণ আছে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ।
এ ছাড়া শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসন ভবন, ড. সত্যেন্দ্রনাথ বসু একাডেমিক ভবন, আচার্য জগদীশচন্দ্র একাডেমিক ভবন, কবি জীবনানন্দ দাশ একাডেমিক ভবন। এভাবে প্রত্যেকটি আবাসিক হল ও অন্যান্য স্থাপনার প্রবেশপথেই শুধু দেখতে পাবেন নাম লেখা। এ যেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নিজস্বতা। বঙ্গমাতা হলে রয়েছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ম্যুরাল। রয়েছে কটকা স্মৃতিস্তম্ভ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহদাকার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি স্থপত্যশৈলী চমৎকার। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে নামকরণ করা হয়েছে এ ভবনটির।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নেই, সেশনজট নেই। তবে, শিক্ষার্থীদের ৩২টি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে। যেগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব, দক্ষতা ও সাংগঠনিক মনোবল অর্জন করে। তারাই সারা বছর উৎসবমুখর রাখে ক্যাম্পাস। শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রক্তদানে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, খেলাধুলার জন্য আন্তবিভাগীয় ক্রিকেট, ফুটবল টুর্নামেন্ট ছাড়াও অ্যাথলেট প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপসানালয় হিসেবে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ ও মন্দির। এ বছর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনির্মিত দৃষ্টিনন্দন ক্যাফেটেরিয়ার উদ্বোধন করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমবিকাশের ধারায় এখন শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনায় বিশ্বমান অর্জনে জোর দেওয়া হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়কে রিসার্চ ফোকাসড ইউনিভার্সিটি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে ডিজিটালাইজেশনের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে।’
উপাচার্য জানান, ‘ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীদের অধিকতর আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে নতুন হল তৈরি, প্রশাসনিক, একাডেমিকসহ সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের গতি ত্বরান্বিত করতে সফট ইনফ্রাস্ট্রাকচারের আওতায় হাইস্পিড ইন্টারনেট ব্যাকবোন, সিকিউরিটি সার্ভিলেন্স সিস্টেম স্থাপন এবং স্মার্ট ক্লাসরুম তৈরি করার উদ্যোগ, নিয়মিত জাতীয়-আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন, জীববিজ্ঞান স্কুলের জন্য গ্রিনহাউস স্থাপন, কেন্দ্রীয় গবেষণাগারকে আন্তর্জাতিক মানসম্মত করার লক্ষ্যে আইএসও সার্টিফাইড করা উদ্যোগ, খেলার মাঠের উন্নয়ন, আবাসিক হলগুলোতে আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব তৈরি, সার্বিক কাজে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার, বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবাসনের সুবিধার্থে ইন্টারন্যাশনাল হল-ডরমেটরি তৈরি ও গবেষণাকেন্দ্র তৈরি।’
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে এতদঞ্চলের মানুষের অপরিসীম অবদান ও ত্যাগ অনস্বীকার্য। আমরা সব সময়ই সে বিষয়টি ধারণ করি। বর্তমান সরকারের ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অভিলক্ষ্য পূরণে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে ডিজিটালাইজেশনের পথে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’
উপাচার্য আরও বলেন, ‘দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে আস্থার জায়গা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ধারণ করেই এ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমান অর্জনের পথে এগিয়ে যাবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখার মেলবন্ধনে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গরূপ পরিগ্রহের পথে। এ বিশ্ববিদ্যালয় শিগগিরই শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিশ্ব পরিমণ্ডলে আরও আলো ছড়াবে; সে প্রত্যাশার সঙ্গে আজ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস-২০২৩ এর এই শুভক্ষণে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।’