বিলুপ্তপ্রায় পাখিগুলো বেঁচে আছে ‘মমি’ হয়ে
দেশি-বিদেশি পাখির অভয়ারণ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বছরজুড়ে ক্যাম্পাসের ডোবা, জলাশয়, জঙ্গল ও পুকুরে নানা প্রজাতির পাখির বসবাস ছিল। সাধারণত শীতপ্রধান দেশগুলোতে শীতের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে বিদেশি পাখিরা অতিথি হয়ে ছুটে আসে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে। তখনই ঠাঁই গুজে নেয় স্বচ্ছ জলের ডোবায়, উঁচু উঁচু বৃক্ষের ডালে কিংবা কোনো দালানের আনাচে-কানাচে। অস্থায়ীভাবে বাসা বেঁধে শুরু করে অল্প দিনের নতুন সংসার। বিশেষ করে শীতের শুরু এবং শেষের দিকে অতিথি পাখির আনাগোনা ও কিচিরমিচিরে ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক দৃশ্যপট ছিল যেন চোখে পড়ার মতো।
তবে সম্প্রতি সেই দৃশ্যপটের আর দেখা মেলে না। অবকাঠামো উন্নয়নের নামে ক্যাম্পাসের জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ, বৃক্ষনিধন করে সৌন্দর্যবর্ধন এবং অতি-আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রকৃতির বাস্তুতন্ত্র তার ভারসাম্য হারাতে শুরু করেছে। ফলে কয়েক বছর আগে যেভাবে পাখিরা ছুটে আসত, সেভাবে এখন আর তাদের দেখা পাওয়া যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা মনে করেন, ‘পরিবেশ ভালো হলেই কেবল পাখিরা সেখানে ছুটে আসে। যেখানে পাখিদের আনাগোনা না থাকবে তাহলে ধরে নিতে হবে সেই পরিবেশের ভারসাম্য নেই।’
ঠিক সেই জায়গা থেকে মানুষকে সচেতন করতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে পাখিমেলা। ‘পাখি প্রকৃতির অংশ ও আনন্দের সঙ্গী, তাদের বাঁচতে দিন’স্লোগানে আজ সোমবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকের সামনে এ মেলার আয়োজন করে বার্ড কনজারভেশন ক্লাব। এতে সার্বিক সহযোগিতা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও ভ্যালেন্ট টেক লিমিটেড।
দিনব্যাপী এ মেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে মৃত পাখির ‘মমি’। শুকনো গাছের ডালে বসিয়ে সেগুলো সাজানো হয়েছে টেবিলের ওপর। এক পলক দেখে বোঝার উপায় নেই যে পাখিগুলো জীবিত নাকি মৃত। তুর্কিবাজ, লক্ষ্মীপেঁচা, সবুজ সুঁইচোরা বা বাঁশপাতি, নীলগলা বসন্তবৌরি, নিশিবক, খয়রা চখাচখি ও ছোট পানকৌরিসহ রয়েছে ১৮টি মৃত পাখির মমি। এগুলো মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ‘অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান মেমোরিয়াল জাদুঘর’থেকে আনা।
আয়োজকরা জানান, ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখিমেলার আয়োজন করা হয়। আগে সেটি শুধু আলোকচিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। গত বছর থেকে মৃত পাখির মমি প্রদর্শন করা শুরু হয়। বিভিন্ন সময়ে ক্যামেরায় ধারণ করা ৬০টিরও বেশি ছবি প্রদর্শন করা হয়েছে এবারের মেলায়। সাধারণত পাখি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও তাদের প্রতি মানুষের যেন ভালোবাসা জেগে ওঠে, সেই লক্ষ্যে এই পাখিমেলার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া আজ সকালে এখানে চিত্রাঙ্কন ও পাখি দেখার প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয়।
মেলায় ঘুরতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাহাত আল খালেদ বলেন, মানুষের যেমন এই পরিবেশে বাস করার স্বাধীনতা রয়েছে ঠিক পাখিদের সেই অধিকার আছে। কিন্তু আমরা তো সেটা হতে দেই না। আমরা গাছ কেটে পাখিদের বাসা ভেঙে দেই, জলাশয়ে মাটি ভরাট করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে দেই। ক্যাম্পাসে হাঁটতে এসে মেলাটি ঘুরে দেখলাম। অনেক পরিচিত পাখির নাম আগে জানা ছিল না, এখানে এসে সেটি জানতে পেরেছি।
ভিন্নধর্মী এই আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আসলাম খান। তিনি বলেন, পাখিরা আমাদের প্রতিবেশী। বাংলাদেশে প্রায় ৭২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যেত। সেগুলো আমাদের আশেপাশেই ছিল। কিন্তু বর্তমানে অনেক পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মেলাতে প্রদর্শিত ছবি ও মৃত পাখির মমি দেখানোর মাধ্যমে মানুষকে বোঝানো হয়েছে যে, এসব পাখি এখন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই পাখি বিপন্নতা ও বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে সবাইকে সচেতন করতে আমরা এই আয়োজন করেছি।
সার্বিক বিষয়ে বার্ড কনজারভেশন ক্লাবের আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা বলেন, ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সকল মানুষকে সচেতন করাই আমাদের উদ্দেশ্য। পাখিরা পরিবেশের একটি নির্দেশক। পরিবেশ ভালো নাকি মন্দ আছে সেটি পাখিরা নির্ধারণ করে। পরিবেশ ঠিক থাকলে সেখানে পাখিরা বসবাস করে। আর যদি পরিবেশ ঠিক না থাকে এবং পাখিদের সুবিধা অনুযায়ী জায়গা না পায় তাহলে সেখানে তারা থাকে না।
অধ্যাপক আমিনুজ্জামান আরও বলেন, পাখিরা বাস্তুতন্ত্রের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদেরকে বিরক্ত না করে ভালোবাসতে হবে। প্রয়োজনে আশ্রয় দিতে হবে। কেউ যাতে তাদের কোনো ক্ষতি না করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখা আমাদের দায়িত্ব। এসব জিনিস চিন্তা করে পাখির প্রতি মানুষের ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে আজকে এই মেলার আয়োজন করা হয়েছে।