বিবর্তনে কৃষির বঙ্গাব্দ
কদিন আগেই অফিসের এক সহকর্মী আরেক সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলেন, আজকে বাংলা মাসের কত তারিখ? যাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি অনেকক্ষণ চিন্তা করে সদুত্তর দিতে না পেরে বললেন, আজকের পত্রিকাটা দেখেন, পেয়ে যাবেন। বাংলা তারিখ নিয়ে দুজনের এই অজ্ঞতায় নিজেরও অস্বস্তি বাড়ছিল। কারণ, বাংলা মাসের তারিখটা তো নিজেও মনে রাখি না। মাসের তারিখ দূরের কথা, মাসের নাম এবং কত সাল তাৎক্ষণিকভাবে তার উত্তর দেওয়া কারো কারো কাছে দূরূহ বৈকি! আধুনিক সভ্যতা আর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব এবং ইংরেজি সনে কর্মজীবনে অভ্যস্ত অনেককেই বাংলা সন, মাস ও সঠিক তারিখ জানার জন্য নির্ভর করতে হয় অন্যের অথবা অন্য মাধ্যমের ওপর। তবে অনেক মানুষ এখনো ফসলের মাঠ আর আকাশের চেহারা দেখে বলে দিতে পারেন ঋতু বা মাসের নাম। কাশবন যেমন বলে দেয় শরতের কথা, শীতের কাঁপুনি বুঝিয়ে দেয় পৌষ ও মাঘ মাস, তেমনি তীব্র গতির ঝড় ও আকাশে মেঘের গর্জন বলে দেয় আসছে বৈশাখ, আসছে কালবৈশাখী। সব গ্লানি মুছে দেওয়ার বারতা নিয়ে আসছে বাংলা নতুন বছর। নগরজীবনে ঋতু বা বাংলা নতুন বছর উদযাপনের অনুষঙ্গ। কিন্তু কৃষিপ্রধান এ দেশটির কৃষকের জীবন আবর্তিত হয় এই বাংলা মাস এবং ঋতুর হিসেবেই। কারণ, কৃষির সংস্কৃতিকে ভিত্তি করেই প্রবর্তন করা হয়েছিল বাংলা সাল। কৃষকদের জন্য পয়লা বৈশাখ নতুন একটি বছর শুরু হলেও খ্রিস্টীয় সালে অভ্যস্ত নগরজীবনে বাংলা নববর্ষ আসে কৃষি ও গ্রামীণ সংস্কৃতিকে মনে করার দিন হিসেবেই।
কৃষি ও বঙ্গাব্দের পটভূমি
বাংলা নববর্ষের সূচনাই হয়েছে বাঙালি কৃষকের সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে। বাংলা নববর্ষের মূলে কৃষক ও কৃষি। মোগল শাসনামলে হিজরি সনের ভিত্তিতে এ দেশে বছর গণনা হতো। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় এ দেশের ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে হিজরি বছরের মিল হয় না। এতে কৃষকদের ফসলি সন গণনায় সমস্যা হয়। অধিকন্তু কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায়েও সমস্যা দেখা দেয়। এ জন্য কৃষক ও জমিদারের সমস্যা দূর করতে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। আর এই কাজ করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর।
১৫৫৬ সালে সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন সম্রাট আকবর (রাজত্বকাল ১৫৫৬-১৬০৫)। সম্রাট আকবর সিংহাসন আরোহণের ২৯ বছর পর অগ্রহায়ণ মাসকে বাংলা সনের প্রথম মাস হিসেবে চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন। তখন অগ্রহায়ণ মাসে কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হতো। সম্রাট আকবর তাঁর রাজসভার নবরত্নের বাইরে দশমরত্ন আমির ফতেহ্উল্লাহ্ সিরাজীকে বাংলা সন আবিষ্কারের দায়িত্ব দেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ সিরাজির নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সনকে সৌর ও চান্দ্র বৈশিষ্ট্যে সমন্বিত করেন। তিনি একটি কেন্দ্রীয় ইলাহি সন করেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন অঞ্চলের ঋতু ও কৃষি উৎপাদনের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রজাদের খাজনা দেওয়ার সুবিধার্থে নানা আঞ্চলিক সনের প্রবর্তন করেন বা আঞ্চলিক সনের কাঠামো নির্দেশ করে দেন। সেই কাঠামো-সূত্র অবলম্বন করেই কোনো কর্তৃপক্ষ বা আঞ্চলিক অধিপতি বাংলা সন চালু করেন। আকবর অন্য যে আঞ্চলিক সন প্রবর্তন করেন তা হলো উড়িষ্যার আমলি সন, বিলায়েতি সন, সুরাসানি সন ইত্যাদি। এই সনগুলোকে বলা হয় ‘ফসলি সন’। বাংলা সনও তেমনি ফসলি সন। ‘আইন-ই-আকবরি’ থেকে জানা যায়, সম্রাট এমন একটি ত্রুটিমুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত সৌর সনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যই আদর্শ হবে। বাংলা সনের মধ্যে তার সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছিল। বাংলা সন একেবারেই স্বকীয়।
৯৯২ হিজরি বা ১৫৮৪ সালকে বিজ্ঞ রাজজ্যোতিষী এবং পণ্ডিত ফতেহ্উল্লাহ্ সিরাজী গবেষণার মাধ্যমে বাংলা সনের উৎপত্তি করেন। ফতেহ্উল্লাহ্ মূলত ৯৬৩ হিজরি, অর্থাৎ ৯৬৩ সনকে সমন্বয় করে বাংলা সন গণনা করা শুরু করেন। এর আগে বঙ্গে প্রচলিত শকাব্দ বা শক বর্ষপঞ্চির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরি সালের মুহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এ জন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১ বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। ৯৬৩ হিজরি সমান ১৫৫৬ সালে ১৪ এপ্রিল সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণ, অর্থাৎ ১ বৈশাখ, ৯৬৩ বাংলা সন। ১০ মার্চ ১৫৮৫ সালে বাংলা সন প্রবর্তন করা হয়। সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে সন শুরুর নির্দেশ দেন সম্রাট আকবর।
আমাদের এ অঞ্চলে ২৪টির মতো সন ছিল। সেসব সন রাজা-বাদশাহ, ধর্ম বা সীমিত অঞ্চলের [ত্রিপুরা রাজ্য], কিন্তু বাংলা সন বাংলাদেশ ও জাতির নামে। তাই এই সন বাঙালির এত প্রিয়, জনজীবনে এত গুরুত্ববহ। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করতেন। পরদিন নববর্ষে ভূ-স্বামীরা তাঁদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পয়লা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
চলতি নববর্ষে বাংলা সন ১৪২৩তম বছরে পদার্পণ করলেও মূলত এর যাত্রা শুরু হয়েছে মাত্র ৪৬০ বছর আগে মোগল শাসনামলে। কারণ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দকে ধরা হয়েছিল ৯৬৩ বঙ্গাব্দ।
বাংলা পঞ্জিকা
ইতিহাসের পাতা থেকে যতদূর জানা যায়, ষোলো শতকে সংস্কৃত পণ্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘নবদ্বীপ পঞ্জিকা’টি প্রকাশিত হয়। এটিই প্রথম মুদ্রিত বাংলা পঞ্জিকা। তার পরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে এর গণনার দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে রামরুদ্র বিদ্যানিধি এবং বিশ্বম্ভর জ্যোতিষার্ণব। এরপর কিছুদিনের জন্য এটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে পঞ্জিকাটি মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হতে থাকে। ১২৯৭ [১৮৯০ খ্রি.] বঙ্গাব্দ থেকে প্রকাশিত হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা।
দেশভাগের পর ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে পঞ্জিকাগুলোর সংস্কারকাজ শুরু হয়। এই পঞ্চাঙ্গ শোধন সমিতির সভাপতি ছিলেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। অন্যদিকে বাংলা সনের পুরোনো নিয়মে মাসের হিসেব নির্দিষ্ট করা যায় না বলে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
বাংলা মাস ২৯ ও ৩২ দিনের পরিবর্তে প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিনের এবং পরবর্তী সাত মাস ৩০ দিনের করা হয়। তবে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে সরকারিভাবে খ্রিস্টীয় সনের পাশাপাশি বাংলা সাল লেখার রীতি চালু হয়। পঞ্জিকা সংস্কারের জন্য ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘টাস্কফোর্স’ গঠন করে তাদের সুপারিশ দেয়। বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত প্রতিমাস ৩১ দিনে এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত প্রতি মাস ৩০ দিনে; গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ৩১ দিনে গণনা করা হবে। তারিখ পরিবর্তনের সময় হবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারে রাত ১২টায়। ১৪০২ সনের বৈশাখ থেকে এটি কার্যকর হয়।
কৃষির মঙ্গল কামনা থেকেই বর্ষবরণ উৎসব
মোগল সাম্রাজ্যের পতন আর ব্রিটিশ শাসনে আবদ্ধ হলেও নদী তীরবর্তী গাঙ্গেয় বদ্বীপের প্রধান জীবীকা থেকে যায় কৃষি। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ধারাবাহিকতায় সময়ের আবর্তে নানা সংস্কার ও বিশ্বাসও জড়িয়ে আছে কৃষি ও কৃষকের জীবনে। এসব সংস্কার প্রথমে কৃষি উৎসবের অঙ্গীভূত ছিল। পরে নববর্ষ উৎসব চালু হলে এসব সংস্কারমূলক আঞ্চলিক উৎসব তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রাচীন এমন একটি সংস্কারমূলক উৎসবের নাম ‘আমানি’ উৎসব। আমানি ছিল মেয়েলি উৎসব, এর লক্ষ্য ছিল পরিবারের কল্যাণ ও পারিবারিক কৃষির সমৃদ্ধি কামনা। এই পারিবারিক উৎসবের আচার সম্পন্ন করতেন বাড়ির কর্ত্রী।
আমানি উৎসব সম্পর্কে ড. মুহম্মদ এনামুল হক বলেন, আমানি উৎসবের লক্ষ্য ছিল সমস্ত বছরের শান্তি কামনা। সুখ-সমৃদ্ধি এবং উৎকৃষ্ট ফসল ফলনের আশা-আকাঙ্ক্ষার কামনা। এটি কৃষকদের উৎসব। চৈত্রসংক্রান্তির রাতে কিষানি ঘরে একটি নতুন ঘটে আতপ চাল পানিতে ভিজিয়ে রেখে তাতে আমগাছের কচি পাতার ডাল রাখা হতো। সারা বছরের মঙ্গল কামনায় পরদিন সকালে ঘর পরিশুদ্ধ করতে এই ঘট হতে ডালটি তুলে পাতার পানি ঘরের চারদিকে ছিটিয়ে দিত। এমনকি কৃষক জমিতে যাওয়ার প্রাক্কালে এই পানি তার শরীরে ছিটিয়ে দেওয়া হতো, যাতে কৃষক বেশি পরিমাণে ফসল ফলাতে পারে।
বিদায়ী বছরের গ্লানি মুছে ফেলার কামনায় কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে নববর্ষ উদযাপন করা হতো। অন্যদিকে চৈত্রসংক্রান্তি বা পয়লা বৈশাখের দিনে গাজন বা চড়ক অনুষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে নতুন বছরের মঙ্গল কামনা। চড়কের বাণফোঁড়ের ক্লেশের মধ্য দিয়ে বিগত বছরের পাপ ক্ষয়ের আরাধনা এবং নতুন বছরের সুখ কামনা করা হতো, এমন বিশ্বাস ও সংস্কার থেকেই হতো এই উৎসব। কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরোনো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে, আবার সংযোগ ঘটেছে অনেক নতুন উৎসবের। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পুণ্যাহ উৎসবের বিলুপ্তি ঘটে। বিলুপ্ত হতে থাকে হালখাতার প্রচলনও।
বর্ষবরণ বৃত্তান্ত
১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ উৎখাত হয়ে যাওয়ার পরই শুধু যুক্তফ্রন্ট সরকার ও তার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেন। তিনি এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতি গঠন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একটি সুস্পষ্ট পথনির্দেশ দান করেন এবং সে বছর বিপুল উৎসাহে বাঙালি তার নববর্ষ উদযাপন করে।
বাঙালিত্বের চেতনার তীব্র চাপে ১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক সরকার বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করে। সেদিন ঢাকার নববর্ষ অনুষ্ঠানে অভূতপূর্ব জনসমাগম হয়। বাংলা একাডেমি, পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ, ছায়ানট, পাকিস্তান তমুদ্দুন মজলিশ, নিক্বণ ললিতকলা কেন্দ্র, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ, সমাজকল্যাণ কলেজ ছাত্র সংসদ, গীতিকলা সংসদ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে হাঙ্গামার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার পরও বাংলা একাডেমির বটতলায় ‘ঐকতান’র অনুষ্ঠানে এত দর্শক-শ্রোতার সমাগম হয় যে ভিড়ের চাপে কয়েকজন আহত হন। এরপর বাংলা নববর্ষকে জাতীয় উৎসবে রূপ দিয়ে রমনার বটমূলে ছায়ানট অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করে ১৯৬৫ সালে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ‘ছয় দফা’ আন্দোলন শুরু করার পর এই আয়োজন এক নতুন রাজনৈতিক তাৎপর্য লাভ করে। সেই থেকে বাংলা নববর্ষ পরিণত হয়েছে সব বাঙালির জাতীয় উৎসবে ।
আর এখনো বাংলা নববর্ষের দিন সরকারি ছুটি হওয়ায় বদলে যায় নগরজীবন। বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে পয়লা বৈশাখের আমেজকে ধারণ করে নগরবাসী ছুটে চলেন গ্রামীণ জনপদের স্মৃতিচারণে। আর এ বছরই প্রথমবারের মতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য চালু হয়েছে পয়লা বৈশাখের উৎসব ভাতা। তাই অন্যদের চেয়ে তাদের জন্য পয়লা বৈশাখ এবার যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
বর্তমানের কৃষি ও নববর্ষ
সভ্যতা যেমন দিন দিন পাল্টে যান্ত্রিকতা এবং প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে, তেমনি সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে এই গাঙ্গেয় বদ্বীপের কৃষির চিত্রও। জলবায়ুর পরিবর্তনে পাল্টেছে চাষবাসের ধরন এবং কলাকৌশলও। জনসংখ্যার চাপ আর কৃষিজমি কমে যাওয়ার ফলে এক ফসল, দুই ফসল থেকে এখন কৃষি হয়ে উঠেছে তিন ফসলি। ফলে সারা বছরই থাকে কৃষকের ব্যস্ততা। আশির দশকে শুরু হওয়া বোরো মৌসুম এখন এ দেশের ধান চাষের প্রধান মৌসুম। ফলে পয়লা বৈশাখ বা নতুন বছর নিয়ে উৎসব আনন্দের চেয়ে কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বোরো ফসল। কারণ, পাকা ধানে মই দেওয়ার মতোই কালবৈশাখী লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে মাঠের ফসল। তাই বৈশাখজুড়েই কিষান-কিষানির ব্যস্ততা গোলায় ফসল তোলার। তার পরও বছরের প্রথম দিনটিতে গ্রামীণ জনপদে থাকে উৎসবের হাওয়া। বৈশাখী মেলা আর বিভিন্ন খেলার আয়োজনের পাশাপাশি আঞ্চলিক সংস্কৃতি অনুযায়ী চলে উদযাপন। বছরের প্রথম দিনটিতে একটু ভালো খাওয়া-পরার চেষ্টা থাকে আর সবার মতো কৃষকেরও।
তাঁদের সেই আচার-কৃষ্টিকে ধারণ করেই শহরে উদযাপন হয় বাংলা নববর্ষ। পান্তা-ইলিশে বাঙালিয়ানার মতো পোশাক পরিধানেও থাকে সেই চেষ্টা। ইট-কাঠের শহরেও গ্রামীণ সংস্কৃতি তুলে ধরার প্রতিযোগিতাও চলে জোরেশোরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের মতো আয়োজনের আদলে দেশের অন্যান্য নগর মহানগরেও থাকে তার ছাপ। তবে সমালোচকদের দৃষ্টিতে প্রাণের উৎসবে নগরের প্রাণহীন নাগরিকদের জাঁকজমক ও বিলাসিতায় ঢাকা পড়তে বসেছে এ দেশের কৃষি ও কৃষকের জন্য প্রবর্তিত বঙ্গাব্দ বা বাংলা সালে কৃষকদের বর্ষবরণ উৎসব। তাদের প্রত্যাশা রূপান্তরের মাঝেও বাংলা বর্ষবরণ হয়ে উঠুক সর্বজনীন।