স্মরণ
আমরা আপনাকে শুনতে পাচ্ছি অ্যান্থনি কোজিয়ার!
সুন্দর-সৌম্য অ্যান্তনি কোজিয়ার চলে গেলেন। অ্যান্তনি সংক্ষিপ্ত হয়ে টনি হয়। তাই টনি কোজিয়ার নামেই বিশ্বব্যাপী শ্রুতকীর্তিমান তিনি। ভদ্রলোককে নিয়ে দু-এককথায় যতি টানা অসম্ভব। আমি বরং দৈনিক আনন্দবাজারের ক্রীড়া সম্পাদক গৌতম ভট্টাচার্যকে উদ্ধৃত করি– ‘টোনি কোজিয়ার হেঁটে গেলে মনে হতো সর্বাঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট ক্যালিপসো বাজছে।’
কত বড়, কত ঐতিহ্যমণ্ডিত সুনীল আকাশে বিস্তৃত ক্যারাবিয়ান ক্রিকেট। কোজিয়ার তার সূত্রধর যেন!
ছোটবেলায় আমি পড়ে যতটা ইংরেজি শিখেছি, ঠিক ততটাই শিখেছি শুনে। টিভিতে ক্রিকেট খেলার ধারাভাষ্য শুনে। ধারাভাষ্য শোনা আমার খুব প্রিয় একটা শখ। আজও সেই শখটা রয়েই গেছে। এমনও গেছে, খেলার মনে খেলা চলছে, আমি তন্ময় হয়ে ধারাভাষ্য শুনছি। খেলায় কোনো মন নেই! খেলা তো তখনই উপভোগ্য হয়ে ওঠে, যখন ধারাভাষ্যটাও হয় একদম ফাটিয়ে ধরে রাখার মতো। এখন সাধ হলেও সময় খুব কম সুযোগ দেয়!
টনি গ্রেগকে এ জন্য ভালো লাগত। উত্তেজনাকর মুহূর্তগুলোতে আমি আজও গ্রেগকে মিস করি। রিচি বেনোকে নিয়ে তো সবাই বলেন– অসাধারণ। অন্য কোনো লোকে তাঁরা নিশ্চয়ই এখন তাঁদের কণ্ঠের অমৃতসুধায় বিমোহিত করে চলেছেন শ্রোতাদের। নাকি তাঁরা বুম না ধরে ব্যাট-বল হাতে তুলে নিয়েছেন কে জানে!
পুরোদস্তুর রাজনীতিক বনে যাওয়ার আগে নব্বই দশকের শেষে, এই শতকের শুরুর দিকে ইমরান খানের ধারাভাষ্যও শুনেছি। কী বৈদগ্ধ্য! সুনীল গাভাস্কারও ঠিক তেমন। কী বিশ্লেষণ!
ইংল্যান্ডের জিওফ্রে বয়কট ও ডেভিড লয়েডের কথা শুনতে ভালো লাগে তাঁদের ভিন্ন উচ্চারণরীতির কারণে। ইয়র্কশায়ার ইংলিশের একটা আলাদা প্রাণ আছে বোধহয়! ‘রানিং’কে কী সুন্দর ‘রুনিং’ বলে ফেলেন বয়কট! ল্যাংকারশায়ারের লয়েডের কথাও দারুণ মজার। উচ্চারণ প্রায় একই মনে হবে, তবুও ইয়র্কশায়ার ইংলিশের সঙ্গে কিছুটা পার্থক্য তো আছেই লয়েডের কথাবার্তার।
হাল আমলে রবি শাস্ত্রী, ওয়াসিম আকরাম, শেন ওয়ার্ন, সঞ্জয় মাঞ্জরেকার, মাইক আথারটন, নাসের হুসেইনরাও মুগ্ধ করার মতো। শাস্ত্রীর দরাজকণ্ঠ একটা মাস্টারপিস। খেলার উত্তেজনার সঙ্গে গ্রেগ-শাস্ত্রীর কম্বিনেশনটা দারুণ ছিল শোনার জন্য। ওয়াসিম-ওয়ার্নের বিশ্লেষণ তো তাঁদের অসাধারণ ক্রিকেট-জ্ঞানের কারণেই যে কারো ভালো লাগার কথা। অনেকের নবজ্যোত সিধুকে ভালো লাগে না শুনেছি। কিন্তু, এই লোক কথার এমনই তুবড়ি ছোটাতে পারেন যে, ‘অতিরঞ্জিত কথাকে’ও সত্য বলে ভ্রম হয়!
বর্ণবৈষম্যের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটে নিষিদ্ধ না হলে, ব্যারি রিচার্ডসের ব্যাটিং রেকর্ড হতো ঈর্ষণীয়। ৪ টেস্টের ক্যারিয়ারেও সেটা তা-ই দেখায়। তাতেই তো কিংবদন্তিতুল্য হয়ে আছেন ৭০ বছর বয়সী ব্যারি রিচার্ডস। তাঁর ধারাভাষ্য এখন আর শুনতে পাই না। বার্ধক্য একটা কারণ হতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার ডিন জোন্স খেলোয়াড় হিসেবে হয়তো কিংবদন্তিতুল্য নন, তবে ভদ্রলোক ধারাভাষ্যকার হিসেবে মনোযোগ ধরে রাখার মতো।
এই তো কিছুদিন আগেও, ভারতীয় পুরোনো ধারাভাষ্যকারদের মার্কেট প্রায় খেয়ে দিয়েছিলেন একজন, সবাই তাঁর নাম ভুলে গেল কি না কে জানে। ভদ্রলোকের নাম সৌরভ গাঙ্গুলী! ইংরেজিতে দ্রুত কথা বলাটা রপ্ত করার আগেই তো ক্রিকেট-প্রশাসনে চলে গেলেন। তুখোড় ক্রিকেট মস্তিষ্ক দিয়ে ভারতকে একটা সময় বাজারি দল থেকে পরিণত করেছিলেন বিশ্বত্রাস দলে। সেই মস্তিষ্কটা ধারাভাষ্যকার সৌরভের মধ্যেও পেয়েছি। তাঁর প্রশাসনে চলে যাওয়ায় হয়তো লাভটা ভারতীয় ক্রিকেটের হয়েছে, তবে, ক্ষতিটা হয়েছে আমাদের মতো আমজনতার!
সবাইকে ভালো লাগলে, ভালো লাগার আর কদর থাকে না। সবাইকে সেরা বললে সেরারও কদর থাকে না। সব কিছুতেই অসাধারণ উচ্চারণ করলে, অসাধারণ শব্দটাই ক্লিশে হয়ে যায়! ব্যাপারটা তখন ওই প্রশ্নটার উত্তরের মতো হয়ে যাবে, ‘ওই নদীটা কোন মহাদেশে?’ একটা উত্তরও যখন হচ্ছে না, তখন প্রশ্নকর্তা বলে বসলেন, ‘মহাদেশ মাত্র সাতটা, আর একটাও না হোক, সাত নম্বরটা নিশ্চয়ই হবে!’
তবে, একদমই ভিন্ন রীতির ভাষার কারণে আপনি আলাদা করে ফেলতে পারবেন ক্যারাবিয়ানদের। তাদের কথা ভালো না লেগে উপায়ই নেই! এ কারণেই মাইকেল হোল্ডিং ও ইয়ান বিশপ আমার প্রিয়। হোল্ডিং কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার। একই সঙ্গে বিশাল ক্রিকেট-পণ্ডিত। অসামান্য বিশ্লেষক। আর বিশপ তো এখন পৃথিবীর সর্বত্র ধারাভাষ্যকারদের কক্ষে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা। বিশপের কণ্ঠটা এখনো শুনতে পাই, কানে লেগে আছে; টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালের শেষ মুহূর্তে তাঁর সেই ক্যারাবিয়ান চিৎকার– ‘কার্লোস ব্রেথওয়েট! কার্লোস ব্রেথওয়েট! রিমেম্বার দ্য নেইম!’
এসব তো প্রাক্তন ক্রিকেটার থেকে যাঁরা বাক্সে ঢুকেছেন তাঁদের কথা। শুনেছি, তাঁদের মধ্যে ব্যাপক ইগোর দ্বন্দ্ব হয় ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে। গ্রেটদের মধ্যে নাকি এটা আরো প্রবল।
এই সব জায়গায়, যাঁরা কখনো উচ্চপর্যায়ে ক্রিকেট খেলেননি তাঁদেরই বরং মানিয়ে নিতে হয়। ক্রিকেট খেলেননি, তবে এই জায়গায়টা সবচেয়ে ভালো মানিয়ে নিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টনি কোজিয়ার ও ভারতের হার্শা ভোগলের নাম আসে বর্তমান সময়ে। তাঁদেরই একজন কোজিয়ার চলে গেলেন গত বুধবার রাতে। আর হার্শাকে তো ব্রাত্যই করে ফেলা হলো!
একটা ব্যাপার দারুণ লেগেছে। হার্শা চলমান আইপিএলে না থেকেও আছেন। ইলেকট্রনিকস সামগ্রী উৎপাদনকারী কোম্পানি ভিডিওকন একটা বিজ্ঞাপন বানিয়েছে। টেলিভিশনের। তাতে মডেল তিনি। বিজ্ঞাপনে হার্শা হাসতে হাসতে বলছেন, ‘আমি স্টেডিয়ামে না থাকতে পারি, স্টেডিয়ামকে তো বাড়িতে নিয়ে আসতে পারি!’ কী অসাধারণ সেন্স! বিসিসিআইকে চপেটাঘাত করার উত্তম পন্থা আর কী হতে পারে! বিসিসিআই হার্শাকে আইপিএল থেকে ছেঁটে দিয়েছে। অথচ, ভিডিওকনের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে হার্শা ফিরে এসেছেন। ওভার শেষ হলেই হার্শাকে দেখা যায়। এই হার্শাকে ছাঁটার সুযোগ তো ভারতীয় বোর্ডের নেই। বাণিজ্যের ক্ষমতার কাছে তাঁর বাণিজ্যিক ক্ষমতা আজ নতজানু, পরাজিত! হার্ষাকে এভাবে ফিরে আসতে দেখে কোজিয়ার কি মৃত্যুর আগে আবারও বলেছেন তাঁর সেই বিখ্যাত কথাটা- ‘কমার্স মে উইন বাট রোম্যান্স উইল নেভার লুজ।’
জানা নেই, জানা নেই! মরণলোকে লোকে চলে গেলে, অনেক সত্যই অজ্ঞাত রয়ে যায়!
মরণলোকে আশ্রয় নেওয়া টোনি কোজিয়ার আমার অসম্ভব প্রিয় একজন ধারাভাষ্যকার। দারুণ ক্রিকেট লেখিয়ে। তাঁর বলায়-লেখায় যেন ক্যারাবিয়ান ক্রিকেট আর ক্যালিপসো ছন্দের রৌদ্রোজ্জ্বল সুধা পান করা যায়। কী দেখেননি তিনি। প্রায় ছয় দশক ধরে ক্যারিবীয় ক্রিকেটকে দেখেছেন। অমিত অভিজ্ঞতা। বিখ্যাত থ্রি ডব্লিউর শেষ দেখেছেন। গ্যারি সোবার্স, যাঁকে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার বলে মানা হয়, তাঁর যুগোত্তীর্ণ কীর্তি দেখেছেন। দেখেছেন ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে ক্যাবিরীয় স্বর্ণযুগ, সাম্রাজ্য শ্রেষ্ঠত্বের বিজয়মাল্য পরার মুহূর্ত।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এসে দেখেছেন সেই যুগের সূর্যাস্ত। হাহাকার করেছেন। ক্ষুব্ধ হয়েছেন। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিয়ে, জগদ্দল পাথর বুকে চাপিয়ে লেখার পর লেখা লিখে গেছেন। বলে গেছেন যা মনে করেছেন সত্য তা, ওই প্রিয় ধারাভাষ্যকক্ষে বসে। তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে!
‘ক্যারিবীয় কণ্ঠস্বর’ চলে গেলেন। কণ্ঠটাই এমন ছিল যে, হঠাৎ শুনলেও বুঝে ফেলা যেত, হ্যাঁ, চলছে কোজিয়ার কথামালা। চলে গেলেন ৭৫ বছর বয়সে। তার আগে তো দেখে গেলেন ‘সম্ভাব্য’ প্রত্যাবর্তনের প্রাণবায়ু। ক্যারিবীয় যুবারা বাংলাদেশ থেকে, ক্যাবিবীয় বড়রা ভারত থেকে বিশ্বকাপ জিতে গেল। কোজিয়ার তো এমন বহু বিজয়ী দৃশ্যের সাক্ষী ছিলেন। মৃত্যুর আগে বিশ্ব জয় করতে দেখলেন ক্যারিবীয়দের। শান্তি!
আসলে কে ছিলেন, কী ছিলেন কোজিয়ার তা আমাদের পক্ষে এক কথায় বলা মুশকিল। ছিলেন বাজান বা বার্বাডিয়ান। অথচ সেই গণ্ডি অতিক্রম করে হয়েছিলেন ক্যারাবিয়ান ঐক্যের প্রতীক, প্রতিভু।
এই ঐক্যের স্বীকৃতিটা খেলোয়াড় হিসেবে পান স্যার ফ্র্যাংক ওরেল, বিশ্ববিখ্যাত ‘থ্রি ডব্লুই’র সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও অগ্রজ; দ্য লিডার, দ্য ফ্রন্টলাইনার। ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জগুলোকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছিলেন সর্বজনীন রূপ। গড়েছিলেন ক্রিকেটীয় বন্ধন। মজার বিষয় হলো, তিন ডব্লুর তিনজনই বারবাডিয়ান। জন্মেছিলেনও মাত্র আঠার মাসের ব্যবধানে, প্রায় কাছাকাছি জায়গায়, দ্য প্যারিস অব সেন্ট মিচেলে। ক্যারিবীয় ক্রিকেটে যত গ্রেট ক্রিকেটার বার্বাডোজ জন্ম দিয়েছে তা দিয়েই একটা বিশ্ব কাঁপানো একাদশ করে ফেলা সম্ভব– জর্জ চালনর, কনরাড হান্ট, ওয়েস হল, ফ্র্যাংক ওরেল, এভারটন উইকস, ক্লাইড ওয়ালকট, গ্যারি সোবার্স, গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্স হেইন্স, জোয়েল গার্নার, ম্যালকম মার্শাল– কী একাদশ!
আর তাঁদের নৈপুণ্য বলে যাওয়ার জন্য, লেখে যাওয়ার জন্যই সম্ভবত জন্ম দিয়েছিল একজন টনি কোজিয়ারকে। কিন্তু না। কোজিয়ার শুধু বাজান হয়ে থাকেননি। সমগ্র ক্যারাবিয়ান ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ কথাকার-ভাষ্যকারের স্বীকৃতি নিয়েই চলে গেলেন অজানা দেশে। যেখানে কিংবদিন্তরা নাকি উইকেন্ডে ক্রিকেট খেলেন। এপাড়ে ৭৫ রানে আউট হওয়ার পর, ওপাড়ে সেই উইকেন্ডে এখন থেকে তিনি দিয়ে যাবেন ধারাবিবরণী। তার পর, একটু বিশ্রাম নিতে ছুটে যাবেন প্রেসবক্সে। হয়তো লেখার রসদ খুঁজবেন এবার।
প্লিজ টনি, লেখাটা পত্রিকার ডেটলাইন ফুরোবার আগেই পাঠিয়ে দেবেন!
কে ছিলেন টনি? গৌতম ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘ফ্র্যাংক ওরেল যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সর্বকালীন রাষ্ট্রদূত হয়ে থাকেন, তাহলে ওরেলের দূতাবাসের ফার্স্ট অফিসার ছিলেন কোজিয়ার। দেশের হয়ে একটা বলও খেলেননি। অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে তাঁর প্রভাব পাঁচ হাজার রান আর তিনশো উইকেটের সমতুল্য।’ ক্যারাবিয়ান ক্রিকেটে তাঁর প্রভাবটা বোঝা গেল তো?
গ্রেট খেলোয়াড়দের নিজেদের মধ্যে ইগোর দ্বন্দ্ব থাকে বলছিলাম। সেটা নিজেদের মধ্যে শুধু নয়। যাঁরা ক্রিকেট খেলেনি তাঁদের সঙ্গে হয়, এটাও লিখেছি ওপরে। কোজিয়ার দৈনিক প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্রকে এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়টাই বলেছিলেন ২০০৯ সালে। বলেছিলেন, ‘একটা ব্যাপার বুঝি, গ্রেট প্লেয়ারদের মধ্যে ইগোর সমস্যা থাকে। যে কারণে আমি যখন ইংল্যান্ডে কমেন্ট্রি করি, বেশির ভাগ সময় দেখি আমাকে জিওফ্রি বয়কটের সঙ্গে দেওয়া হয়। হার্শা ভোগলেরও হয়তো বয়কটের সঙ্গেই বেশি পড়ে। অন্যদের হয়তো বয়কটের সঙ্গে মেলে না অথবা বয়কটের ওদের সঙ্গে।’
তারপর বয়কটের সঙ্গে ধারাভাষ্য দেওয়ার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিজের সীমাবদ্ধতার কথাটাও জানিয়ে দেন সমস্বরে, ‘ডিফিকাল্ট। ভেরি ডিফিকাল্ট। আত্মগরিমা খুব বেশি। ওর সঙ্গে কমেন্ট্রি করাও সহজ কাজ নয়। তবে আমি মানিয়ে নিই। কমেন্ট্রি করার সময় আমি সব সময় আমার সীমাটা মনে রাখি। কখনো ভুলি না যে আমি টেস্ট ক্রিকেটার নই।’
এটাকে বলে মানুষ হিসেবে সততা। এর কিছুক্ষণ আগেই তিনি কী অকপটে শুধুই সাবেক খেলোয়াড়দের দিয়ে ধারাভাষ্য করানোর প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেছেন, ভাবতেই অবাক লাগে। বলেছেন, ‘আমি জানি না, টেলিভিশন কোম্পানিগুলো কমেন্টর নেওয়ার সময় কী মানদণ্ড বিবেচনা করে। তবে এটা বুঝতে পারি, আস্তে আস্তে এটি সাবেক টেস্ট ক্রিকেটারদের সম্পত্তি হয়ে যাচ্ছে। আমি আর ভারতের হার্ষা ভোগলে ছাড়া টেস্ট ক্রিকেটারের বাইরে আর কোনো আন্তর্জাতিক কমেন্টর তো নেই-ই।’
এটাকেও সাহস ও সততা বলে। তবুও ক্রিকেটাররা কখনো তাঁকে অসম্মান করেননি। তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাবর। এই যে ব্রায়ান লারা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে যাঁর স্থান প্রায় পাকা, সেই তিনিও নিজের ক্যারিয়ারের বাঁক বদলে কোজিয়ারকে কৃতিত্বের ভাগিদার বানান। কোজিয়ারকে ‘জীবন্ত ইতিহাস বই’ স্বীকৃতি দিয়ে শোকগাথায় লারা বলেছেন, ‘আমার ক্যারিয়ারে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু মুহূর্ত ভাগাভাগি করেছিলাম, যেটা আমার ক্যারিয়ারে একটা টার্নিং পয়েন্ট। ঘটনাটা ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ৫-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট হারার পরের। আমি টনির কাছে এ ব্যাপারে পরামর্শ নিতে গেলাম। কারণ, আমার বিশ্বাস ছিল, তিনি সেই ব্যক্তি যাঁর আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়া এবং এই বাজে প্যাঁচ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার করণীয় বিষয়ে একটা প্রত্যক্ষ ধারণা আছে। ওই পরামর্শগুলো পরের দুটো টেস্ট জয় করে তখনকার বিশ্বসেরা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ ড্র করতে আমাদের সাহায্য করেছিল।’
তাঁর হাত ধরেই ধারাভাষ্যে এসেছিলেন ক্যারিবীয় কিংবদন্তি পেস কোয়ার্ট্রেটের অন্যতম মাইকেল হোল্ডিং। আশির দশকের শেষের দিকে। সেই হোল্ডিং কোজিয়ারের মৃত্যুর পর ক্রিকইনফোকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। কী অসাধারণ সেই সাক্ষাৎকার। হোল্ডিং কত বড় বোলার ছিলেন। অথচ কোজিয়ারকে ব্যাখ্যায় কতটা বিনয়ী, সশ্রদ্ধ!
আজকাল দু-একটা সেঞ্চুরি-টেঞ্চুরি বা ম্যাচ জেতানো পারফর্ম করে যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাররা সাংবাদিককের দেখে নাক সিঁটকান বলে শুনি, সাংবাদিকদের বেতন-টেতন নিয়ে ঠাট্টা-মসকরা করেন, তাঁদের সাক্ষাৎকারটা পড়া উচিত। অনেক কিছু শিখবেন। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের প্রতি এমন শ্রদ্ধা, ছোট-বড় সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এখনকার ক্রিকেটারদের মধ্যে শুধু মাশরাফি বিন মুর্তজার মধ্যেই দেখা যায়। কম গল্প তো শুনলাম না এসব নিয়ে!
হোল্ডিংয়ের কোজিয়ারের প্রতি শ্রদ্ধা এতেটাই যে ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখি আর কথা বলার জগতে কোজিয়ারকে তিনি সেরা ক্যারিবিয়ান মনে করেন। বলেছেন, “যদি আপনি ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের দিকে এবং শ্রদ্ধাভাজন কণ্ঠগুলোর দিকে ফিরে তাকান, সেই মানুষগুলোর দিকে তাকান, যাঁরা ষাট বছর ধরে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট নিয়ে লিখছেন, তাঁদের মধ্যে টনি কোজিয়ার, আমার মতে, অনেকটা ব্যবধান রেখেই প্রথম, তারপর টনি বাক্কা। আমরা এমন মানুষের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মতো খুব বেশি কাউকে দেখিনি। কে পরের ব্যক্তি, কে উঠে আসবেন এবং ক্যারিবিয়ান মানুষদের শ্রদ্ধার পাত্র হবেন? যার দিকে মানুষ তাকিয়ে থাকবে এবং বলবে, ‘যদি এই মানুষটা এটা নিয়ে লেখেন কিংবা এটা নিয়ে কথা বলেন, তাহলে আমাদের শুনতে হবে যে তিনি কী বলছেন।’ এ মুহূর্তে সেই স্থানটা নেওয়ার মতো আমি কাউকে দেখছি না।”
হোল্ডিংয়ের কণ্ঠেই শোনা গেল, কোজিয়ারের সেই স্থানটা এমনই অবিসংবাদিত যে তাঁকে গ্যারি সোবার্সের পাশেই বসিয়ে দিয়েছেন তিনি! এটাকে বলে চূড়ান্ত শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। বড় মানুষ ও উদারতার পরিচয়। হোল্ডিংয়ের মূল্যায়ন, ‘ক্যারিবিয়ানে টনি কোজিয়ার একদম গ্যারি সোবার্সের পাশেই থাকবেন। আমি মনে করি, সারা বিশ্বের মানুষ গ্যারি সোবার্সকে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হিসেবেই দেখে। আমি বলছি না যে, বিশ্বে টনি কোজিয়ারই শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট লেখক ও ধারাভাষ্যকার, কারণ আমি জন আর্লটের মতো মানুষের কথা অনেক শুনেছি। তবে, ক্রিকেট খেলতে গিয়ে এবং ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকার সূত্রে যা জেনেছি, তাতে আমি জানি যে, তাঁর চেয়ে ভালো ক্যারিবিয়ানে আর কেউ নন।’
যে অদ্বিতীয় অদৃশ্যলোকেই থাকুন, আবার কথা বলুন, লিখুন অ্যান্থনি কোজিয়ার! আর খুব খুব ভালো থাকুন...
আপনি তো দেখে গেছেন বাণিজ্যের যুগে কোথায় দাঁড়িয়েছে ক্রিকেট আর কোথায় দাঁড়িয়েছে ক্রিকেটের বা রোমান্স। আপনি কি অনন্তলোক থেকে সেই ভরাটকণ্ঠে বলে চলেছেন, ‘কমার্স মে উইন বাট রোমান্স উইল নেভার লুজ।’
আমরা আপনাকে শুনতে পাচ্ছি অ্যান্থনি কোজিয়ার!
লেখক : গবেষক ও সংবাদকর্মী