রক্ত দিয়ে জ্বাললো যারা প্রদীপগুলো
বুদ্ধিজীবীরা জাতিকে শ্রেষ্ঠত্বে পৌঁছে দিতে আমৃত্যু দেশের জন্য কাজ করেছেন। বাঙালির অধিকার আদায়ের সেদিনগুলোতে তাদের অটল অবস্থান কাঁপিয়ে দিয়েছিল হানাদার শাসকের মসনদ। তাই জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তাদের। মেরেই ক্ষান্ত হয়নি হানাদারেরা, একইগর্তে ফেলেছিল শহীদদের দেহ, কাউকে আবার দিয়েছিল পুড়িয়ে। জীবনের বিনিময়ে এই বুদ্ধিজীবীরা দেশের মাটিতে বুনে গিয়েছিলেন আদর্শের বীজ, রক্ত দিয়ে জ্বেলেছিলেন প্রদীপ, যা আজও জ্বলছে। প্রজাতান্ত্রের প্রতি সমর্থন ও সত্তায়নে তাদের অবদানে আমরা আজীবন ঋণী। তাই এই মহান আদর্শ স্থাপনকারীদের ঋণ আমরা স্মরণ করি ১৪ ডিসেম্বরে।
যদিও একটি দিবসে আড়ম্বরতা থাকলেও প্রতিটি দিবসেই স্বাধীন-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসীরা অনুভব করেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ। মুক্তিযুদ্ধে তাদের সাহসী আত্মা ভর করে আজও তাই বিপ্লবীর মনে-প্রাণে। দেশের মানবিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক সমৃদ্ধির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা অনুভূতি জাগায়; মুক্তিসংগ্রামী যোদ্ধাদের শ্রদ্ধাশীল ও সমর্পণশীল মৌলিক অধিকারের প্রতি সচেতন করে। আজ সেই ঐতিহাসিক শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ১৪ ডিসেম্বর।
মানুষের হৃদয়কে আজও আন্দোলিত করা দিনটি স্মরণ করিয়ে দেয় দেশপ্রেম, জাগ্রত করে মানবিক মূল্যবোধ, সচেতন করে মা-মাটি-মানুষের অধিকারের জন্য কথা ও কাজের মিল রাখতে; দেশদ্রোহী রাজাকার, আল বদর ও আলশামসদের মতো ঘাপটি মেরে দেশের মাটিতে জেগে থাকাদের থেকে সাবধান হতে। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাত থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের একেবারে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস জানতে প্রেরণা যোগায় দিনটি। যে ইতিহাস সময়ের প্রয়োজনে দেশপ্রেমীর মনকে করে তোলে পরিশুদ্ধ, পরিপুষ্ট।
পাকিস্তানি বাহিনী যখন বুঝতে পেরেছিল তাদের পরাজয় সুনিশ্চিত, তখন তারা বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে আঁকে ঘৃণ্য নীলনকশা। সেই নীলনকশা অনুযায়ী চূড়ান্ত হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে তারা। রক্তের হলিখেলা খেলে ৭ থেকে ১৪ ডিসেম্বর। বেছে বেছে শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পীদের হত্যা করে।
১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যার চূড়ান্ত পর্বে আমরা হারাই একাধারে আমাদের বিজ্ঞদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্বী শিক্ষক এম মুনিরুজ্জামান, ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, সুরসাধক আলতাফ মাহমুদ, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ডা. যোগেশচন্দ্র ঘোষ, কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নতুনচন্দ্র সিংহ, সাংবাদিক মেহেরুন্নেসা, সেলিনা পারভিন, শহীদ সাবের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ও বিশিষ্ট নাট্যকার অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রাশীদুল হাসান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহম্মদ, সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, নিজামউদ্দীন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফাসহ বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনরা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক বুদ্ধিজীবীর লাশ রাজধানীর মিরপুর, রায়েরবাজার বধ্যভূমিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়।
অলৌকিক এই সব মানুষেরা প্রাণ দিয়েও নতুন প্রজন্মকে জাগিয়ে রেখে গেছেন। তারা যে প্রদীপ জ্বেলে রেখে গেছেন, সেই আলোয় যে ভাসতে পারে, সে-ই হয়ে ওঠে কিংবদন্তি, বাকিরা পুড়ে হয় কয়লা।