একাত্তরের মার্চ
যেন এক অনন্ত যাত্রা (শেষ কিস্তি)
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতে প্রবেশ
৩০ মার্চ, ১৯৭১ বেলা ৩টার দিকে আমি ও তাজউদ্দীন ভাই সীমান্তের পথে রওনা হই। প্রথমে আমরা ভারতীয় সীমান্তের বিওপির দিকে যাই। সীমান্ত অতিক্রমের সময় চুয়াডাঙ্গা থেকে সহযোগিতাকারী হিসেবে দুজন ব্যক্তিকে সাথে নিয়েছিলাম। একজন মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, অন্যজন ঝিনাইদহের তৎকালীন এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন। আমাদের বিষয়ে ভারতীয় বিএসএফের সাথে আলোচনার জন্য তাঁদের দায়িত্ব দেওয়া। কোন কোন বিষয়ে কথা বলতে হবে সেগুলোও সুনির্দিষ্টভাবে তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের বললাম, আপনারা চেকপোস্টে গিয়ে নিচের কথাগুলো বলবেন এবং প্রয়োজনে একাধিকবার বলবেন :
‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের দুজন ব্যক্তি ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার জন্য ভারতে প্রবেশ করতে চান। তাঁরা একটি মাত্র শর্তেই আসবেন, যদি তাঁদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রিসিভ করা হয়।’
উপরোক্ত বার্তা দিয়ে তাঁদের পাঠানো হলো। এটা খুবই সুচিন্তিত ও সুগঠিত একটি বার্তা ছিল। আমরা জানতাম, মেসেজটির উত্তর ভারতীয় চেকপোস্টে কর্তব্যরত ওই অফিসার দিতে পারবেন না। কলকাতায় যিনি বসে আছেন, বিএসএফের ইস্টার্ন কমান্ড চিফ, তিনিও দিতে পারবেন না। এমনকি দিল্লিতে কমান্ডার ইন চিফ যিনি বসে আছেন, তিনিও এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। একমাত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ প্রস্তাবের উত্তর দিতে পারবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী উত্তর দিলেই আমরা যাব।
সীমান্ত থেকে কিছু দূরে একটি জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট খালের ওপর ব্রিটিশ যুগের তৈরি একটি কালভার্ট। কালভার্টের ওপর তাজউদ্দীন ভাই ও আমি বসে আছি। তাজউদ্দীন ভাইকে বিষণ্ণ মনে হলো। তাঁর বিষণ্ণতার কারণ জিজ্ঞেস করি। তিনি বললেন, আমি হেরে যাচ্ছি। আমি বললাম, আমরা এখন বিজয়ের পথে যাচ্ছি, একটা ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। এই যে দেখুন সূর্যটি অস্ত যাচ্ছে, এ অস্তগামী সূর্যের সাথে সাথে আমাদের পরাধীন যুগেরও সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। খুব শিগগির স্বাধীনতার নতুন সূর্য উঠবে, আর উত্তুঙ্গ প্রত্যাশার এমন একটি দুর্লভ মুহূর্তে আপনি বলছেন আপনি হেরে যাচ্ছেন? এর অর্থ আমি বুঝতে পারছি না।
তাজউদ্দীন ভাই বললেন, ছোটবেলার একটা কথা তাঁর মনে পড়ছে। তিনি বলতে থাকেন, ছোটবেলায় স্কুলের হিন্দু সহপাঠীরা বলতেন, তোদের পাকিস্তান টিকবে না। আমি পাল্টা জোর দিয়ে বলতাম অবশ্যই টিকবে। তথ্য ও নানা প্রকার যুক্তি তুলে ধরে প্রমাণ করতাম যে, পাকিস্তান একটা টেকসই রাষ্ট্র হবে। আমি যুক্তিতর্কে জিতে যেতাম। আজ আমি হেরে যাচ্ছি। ছোটবেলার সহপাঠীদের কথা তাঁর মনে পড়ছে। সূর্য ডুবুডুবু করছে, বাংলাদেশের আকাশে আবার কখন নতুন সূর্যের উদয় হবে, তা ভাবতে ভাবতে আমরা দুজনেই কালভার্টের ওপর শরীর এলিয়ে দেই।
তৌফিক-ই-ইলাহী ও মাহবুব চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ কেটে গেল। ওরা ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়িতে গেছে। জঙ্গলের ভেতর বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে। চারদিকে কোনো জনবসতি নেই বললেই চলে। গত এক মাসের অসহযোগ আন্দোলন থেকে আমরা এখন প্রবেশ করতে যাচ্ছি আরেক অধ্যায়ে। ঢাকা ছেড়ে আমরা এখন ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় সীমান্তে অবস্থান করছি। কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। তাজউদ্দীন ভাইকে ডেকে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াই। শব্দ ধীরে ধীরে আমাদের দিকেই আসছে। আগন্তুকরা কাছে এসেই হাতের অস্ত্র উঁচু করে সামরিক কায়দায় আমাদের অভিবাদন জানান। অফিসারটি জানান, আমাদের তিনি যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে তাঁদের ছাউনিতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। অফিসারটি বললেন, ‘স্যার, ইউ আর ইনভাইটেড টু ভিজিট আওয়ার ক্যাম্প।’ ঠিক যেভাবে বিদেশি রাষ্ট্রের সম্মানিত অতিথিকে গার্ড অব অনার দিয়ে নিয়ে যায়, আমাদেরও সেভাবে আমন্ত্রণ জানানো হলো।
তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন ও আমি, আমাদের এ তিনজনের মধ্যে কথা ছিল, এই যে নন-কো-অপারেশন মুভমেন্ট, এর একটা সীমা (হাইট) আছে। এটা একসময় দুদিক থেকে ভেঙে পড়তে (কোলাপ্স করতে) পারে। অন্যদিকে অসহযোগ আন্দোলন চলার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে ক্রমেই পূর্ব পাকিস্তান দুর্বল হয়ে পড়তে থাকবে। অতএব কতদিন পর্যন্ত এটা বিলম্ব (লিংগার) করা যাবে? প্রথমে কে আঘাত করবে? এটা একটা নার্ভ ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধ। অতএব তাদের নার্ভ আগে ব্রেক করবে, নাকি আমাদের নার্ভ ব্রেক করবে? আমাদের নার্ভ যাতে আগে ব্রেক না করে, আমরা তার ব্যবস্থা রাখছি। কিন্তু ওদের নার্ভও কিন্তু একটা জায়গায় ব্রেক করবে। সে জন্য আমাদের প্রতিহত করার এবং এটাকে ওভারকাম করার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে। এ বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছি। আমি বঙ্গবন্ধুকে বলেছি, একপর্যায়ে আপনাকে আর্মস স্ট্রাগল করতে হবে। উনি বলেছেন, আমাকে নিয়ে তোরা কোথায় রাখবি? আমার কি লুকানোর জায়গা আছে? আমি এটাও বুঝতে পেরেছিলাম, ইন্ডিয়াতে আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অনীহা আছে। এটা তিনি মুখ থেকে বলেছেন তা নয়। এটা ছিল আমার অনুমান। অনুমান এ কারণে যে, তিনি যখন একবার আগরতলায় গিয়েছিলেন, সে সময়ে আগরতলা থেকে তিনি আশাহত হয়ে ফিরে এসেছিলেন।
পাকিস্তান আমলে ভারতের কূটনৈতিক বিষয়ে সব যোগাযোগ ইসলামাবাদের মাধ্যমে হতো। ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসে যাঁরা ছিলেন তাঁরা ইসলামাবাদের মাধ্যমে যোগাযোগ করতেন ভারতের সাথে। এ সময় আমেরিকান দূতাবাসও বিষয়গুলোর ওপর খবরাখবর রাখত। এখানে যে কনস্যুলেট ছিলেন, তাঁরা এখানকার আন্দোলন-সংগ্রাম সম্পর্কে সহানুভূতিশীল ছিলেন। এ বিষয়ে আমি নিজেই সাক্ষী।
অসহযোগ আন্দোলন তখন চলছে, আমাকে একদিন টেলিফোন করলেন ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা। বললেন, তিনি আমার সাথে দেখা করতে চান। তখন ঢাকায় তেমন ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট ছিল না। বিজয়নগরে সেক্রেটারিয়েটের উল্টোদিকে একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্ট ছিল, ওখানে আমরা বসলাম। কর্মকর্তার নাম মি. স্কট ব্রুটস। তিনি ছিলেন ঢাকাস্থ আমেরিকান কনস্যুলেটের পলিটিক্যাল অফিসার। তিনি বললেন, আমাকে একটা মেসেজ দেওয়ার জন্য এসেছেন। অনেক বিষয়েই আলোচনা হলো তাঁর সঙ্গে। তিনি আরো জানালেন, ‘আমেরিকান দূতাবাসের ঢাকা অফিসে যাঁরা আছেন, তাঁরা বাংলাদেশের দাবির ব্যাপারে খুবই সহানুভূতিশীল। কেননা আপনাদের দাবি ন্যায়সঙ্গত-যুক্তিপূর্ণ। কিন্তু যেটা আমি বলবার জন্য এসেছি, সুনির্দিষ্টভাবে তা হলো এই যে, যুক্তরাষ্ট্রের State Department-এর CIA Map-এ বাংলাদেশ বলে কোনো রাষ্ট্র নেই।’ এ ম্যাসেজ তারা অন্য একটি সূত্রে বঙ্গবন্ধুকেও দিয়েছিলেন বলে মনে হয়েছে। এটা তিনি সহানুভূতির সাথে বললেন। আগরতলার স্মৃতিটা আমার মনে কাজ করছিল। এজন্য আমরা বর্ডার ক্রস করার সময় দুজনকে পিক করলাম। আগরতলার বিষয়টা মনে রেখে আমরা ওদের দিয়ে মেসেজটি পাঠিয়েছিলাম।
পরে জেনেছিলাম, ভারতে বিওপি (BOP: Border Out Post)) থেকে বার্তা পাঠানো হয় বিএসএফের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান গোলক মজুমদারের কাছে। তিনি বিএসএফের সর্বভারতীয় প্রধান দিল্লিতে অবস্থিত কে এফ রুস্তমজির সাথে যোগাযোগ করেন।
আমাদের আগমনের খবর এরই মধ্যে কলকাতায় পৌঁছে গেছে। বিএসএফের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান আমাদের সাথে দেখা করার জন্য রওনা দিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিএসএফের আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার ছাউনিতে এসে পৌঁছালেন। মজুমদার জানান, তাঁদের হাইকমান্ডের নির্দেশেই তিনি এখানে এসেছেন। মজুমদার বললেন, ‘আপনাদের প্রশ্নের জবাব শুধু একজন ব্যক্তিই দিতে পারেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী।’ তিনি জানান, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। তাঁর সাথে কলকাতা যাওয়ার জন্য আমাদের অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, তাঁর পক্ষে ছোট ছোট অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া সম্ভব। তবে দিল্লির সাথে আলোচনা ছাড়া বড় কিছু করা সম্ভব নয়। তিনি বললেন, এখানে আসার আগে আমি দিল্লিতে যোগাযোগ করেছিলাম, সেখান থেকে আজ রাতেই একজন আসছেন আপনাদের অভ্যর্থনা জানাতে। আমরা গোলক মজুমদারের কথায় রাজি হলাম। তৌফিক-ই-ইলাহী ও মাহবুবকে বিদায় দিয়ে গোলক মজুমদারের জিপে করে তাজউদ্দীন ভাই ও আমি কলকাতা যাত্রা করি।
গাড়িতে কথা প্রসঙ্গে জানলাম, গোলক মজুমদার ইতিহাসের ছাত্র। তিনি বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি কবিতাটি শুনিয়ে বললেন, বাংলা এমনই একটা জায়গা যেখানে বহিরাগতরা কোনোদিনই পেরে ওঠেনি। মান সিংয়ের উদাহরণ টেনে তিনি বললেন, ওরাও পারেনি এবং এই যে আজ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আপনাদের ধ্বংস করতে নেমেছে, দেখবেন তারাও পারবে না, জয় আপনাদের সুনিশ্চিত। এমন আশ্বাসবাণী শোনাতে শোনাতে গোলক মজুমদার আমাদের কলকাতায় দমদম বিমানবন্দরে নিয়ে আসেন। তিনি জানান, আমাদের সাথে আলোচনার উদ্দেশে এই ফ্লাইটে দিল্লি থেকে একজন কর্মকর্তা আসবেন। তার এ কথা শুনে আমরা কিছুটা আশ্চর্য হই। জিপ থেকে নামিয়ে আমাদের অপেক্ষাকৃত বড় কালো রঙের একটি গাড়িতে তোলা হলো। বিমান থেকে ছয় ফুটেরও বেশি লম্বা একজন লোক নেমে সোজা আমাদের গাড়িতে উঠলেন। মজুমদার তাঁর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি হলেন বিএসএফের সর্বভারতীয় প্রধান কে এফ রুস্তমজি। তিনি একসময় ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নিরাপত্তাপ্রধান ছিলেন। সে কারণে নেহরু পরিবার এবং ইন্দিরা গান্ধীর সাথে রুস্তমজির ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রীর খুবই আস্থাভাজন। পরে জেনেছিলাম, রুস্তমজি গোলক মজুমদারের মেসেজ পাওয়ার পর কোনো প্রটোকল না মেনে সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যোগাযোগ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে বলেছিলেন, “আপনি নিজে গিয়ে তাঁদের রিসিভ করবেন। তাঁদের দেখে আপনার খুব ‘ইমপ্রেসিভ’ মনে হবে না। বাঙালিরা অত্যন্ত আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন।” তাঁদের সাথে আমাদের ব্যবহারটি যেন তেমনি তাঁদের উপযোগী হয়। ভাগ্য আমাদের সুপ্রসন্ন হলো।
এদিকে আমাদের কাপড়-চোপড়ের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। গাড়িতেই শুরু হয় আলোচনা। রুস্তমজির প্রথম প্রশ্ন ছিল, বঙ্গবন্ধু কোথায়? মজুমদারের প্রথম প্রশ্নও ছিল এটা।
এরপর আরো অনেকের সাথে দেখা হয়েছে, সবারই প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা তৈরি ছিলাম। দলীয় নেতারা, মুক্তিযোদ্ধাসহ সবার সাথে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের ব্যাপারে আমরা একটিই উত্তর দিয়েছি। আমরা বলতে চেয়েছি, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি জানেন আমরা কোথায় আছি। তিনি আমাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন, সময় হলে বা প্রয়োজন দেখা দিলে, তিনি উপযুক্ত স্থানে আমাদের সাথে দেখা করবেন।
একটি সুন্দর বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। একটি ঘরে আমি আর তাজউদ্দীন ভাই, অন্য ঘরে রুস্তমজি। আমরা খুবই ক্লান্ত। গোসল করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সাথে অতিরিক্ত কোনো কাপড় নেই। রুস্তমজি আমার পরিধেয় বস্ত্রের অভাবের কথা জেনে তাঁর ইস্ত্রি করা পায়জামা ও কোর্তা দিলেন। ছয় ফুট লম্বা মানুষের কোর্তা সামাল দেওয়া আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। দেখলাম পায়জামার দরকার নেই, শুধু কোর্তা হলেই চলে।
কে এফ রুস্তমজি (K. F Rustamji) তাঁর লেখা The British, The bandits and The Borderman বইয়ে বিষয়গুলোর চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন,
‘পূর্ব পাকিস্তানে ক্র্যাকডাউনের তিনদিনের মধ্যে গোলক মজুমদার আমাকে জানালেন, আওয়ামী লীগের কিছু সিনিয়র নেতা এবং সম্ভবত শেখ মুজিব কুষ্টিয়া সীমান্তে কৃষকের বেশে গোপনে অবস্থান করছেন। আমি ৩০ মার্চ রাত ১২টার পর বিমানে কলকাতা পৌঁছাই। গোলক স্বভাবসুলভ হাসিমুখে কলকাতায় আমাকে অভ্যর্থনা জানান।’
‘তিনি আমাকে বললেন, ওখানকার আন্দোলনের দ্বিতীয় ব্যক্তি (number two man ) আমাদের কাছে এসেছেন। আপনি কি তাঁর সাথে দেখা করবেন? আমি বললাম, অবশ্যই এবং এখনই।’
‘আমরা হেঁটে জিপের কাছে গেলাম এবং দেখলাম তিনি বসে আছেন। আমরা তাজউদ্দীন আহমদ এবং আমীর-উল ইসলামকে আসাম হাউসে নিয়ে গেলাম। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর রাজগোপাল নিশ্চিত করলেন, তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলনে শেখ মুজিবের পর দ্বিতীয় ব্যক্তি। গোলক মজুমদারের কাছ থেকে জেনেছি, তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে বলেছেন, আমাদের নেতা মুজিব ভাই আমাদের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ আন্দোলনে দায়িত্ব নিতে বলেছেন। বঙ্গবন্ধু বারবার আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন এমন কোনো কাজ করা যাবে না যাতে ভারত বিব্রত হয়, চীনের বিরুদ্ধে কোনো Provoke করা যাবে না এবং এমন কিছু করা যাবে না যাতে আন্তর্জাতিক বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।’
তখন প্রায় মধ্যরাত। স্নানের কাজ সেরে নিলাম। এত রাতে খাবার পাওয়া কষ্টকর। রুস্তমজি ফৌজি ট্রেনিংয়ের অভ্যাস হিসেবে সব সময় নিজের সাথে ভাঁজ করা একটা স্টোভ রাখতেন। ইচ্ছা করলেই সেটা দিয়ে রুটি তৈরি বা ডিম সিদ্ধ করা যায়। তিনি কয়েকটা রুটি ও ডিম সিদ্ধ করে দিলেন। সাথে গরম চা। অতি তৃপ্তির সাথে আমাদের সারা দিন পর আহার হলো। খাওয়ার পর টেবিলের ওপর রাখা একটি মানচিত্রের দিকে আমরা চোখ রাখি। কোনোদিন যুদ্ধ করিনি বা এর কথা ভাবিনি। অথচ আজ যুদ্ধের পরিকল্পনায় অংশ নিতে হচ্ছে। রুস্তমজি রণকৌশলী। আমাদের মূল উদ্দেশ্য তাঁকে সংক্ষেপে অবহিত করলাম। আজ রাতেই আমাদের অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সে রাতেই পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ চিফ, বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সেখানে আনা হলো এবং তাঁদের সাথে আমাদের বৈঠক হলো। তাজউদ্দীন আহমদ বিস্তারিতভাবে আমাদের আন্দোলন থেকে শুরু করে সমস্ত পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন। ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সবই আমাদের মুক্ত এলাকা ঘোষিত হয়েছে। আমরা কী পরিস্থিতিতে এখানে এসেছি তাও সবাইকে বুঝিয়ে বললেন।
আমাদের প্রথম কাজ হলো দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের একত্র করে তাঁদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা। দ্বিতীয় কাজ হলো, মুক্তিযুদ্ধকে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করা। বিএসএফের বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের এই গভীর রাতে ডেকে আনা হয়।
আওয়ামী লীগের এমএনএ, এমপিএসহ নেতাদের একটি তালিকা তৈরি করে এতে তাঁদের সম্ভাব্য অবস্থানের কথা উল্লেখ করা হয়। এসব নেতার সাথে যোগাযোগের জন্য এ তালিকা বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়িতে পাঠানো হয়। যশোর সেনানিবাস অবরুদ্ধ, কুষ্টিয়াতে আমরা জয়লাভ করেছি এবং চুয়াডাঙ্গাও আমাদের শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে অতিদ্রুত আমাদের সুসম্বদ্ধ হয়ে উঠতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের এ খবর পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। বিএসএফের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাসহ নেতাদের কাছে নির্দেশ পৌঁছে দেওয়া শুরু করি।
যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাসম্ভব সাহায্য দিতে বিএসএফ রাজি হলো। পরামর্শ করতে রাত প্রায় শেষ হয়ে গেল। ভোরের দিকে কিছুক্ষণের জন্য আমরা বিছানায় যাই। ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে রেডিওর শব্দ শুনি। বিএসএফের সুজয় চট্টোপাধ্যায় এ রেডিও দিয়েছিলেন। রেডিওতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী শুনি। আমাদের মা-বোনদের ওপর বর্বর অত্যাচারের কথা শুনে মনের অজান্তেই বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো দু চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো।
১ এপ্রিল আমাদের দিল্লি যাওয়ার কথা। বিএসএফ ও অন্যরা খুবই সাবধানতা অবলম্বন করছে আমাদের অবস্থান গোপন রাখার জন্য। পরের দিন সকালে সীমান্তের দিকে যাই।
খবর অনুযায়ী মেজর ওসমান অস্ত্রশস্ত্রের একটা তালিকা তৈরি করে নিয়ে আসেন। মেজর ওসমানকে কিছু অস্ত্র দেওয়া হলো। এর মধ্যে এলএমজিও ছিল। এরই মধ্যে খবর এলো, পাক সৈন্যরা যশোর সেনানিবাস থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। তাকে এক্ষুনি যেতে হবে। মেজর ওসমান সদ্য পাওয়া এলএমজি কাঁধে নিয়ে দ্রুত রওনা হলেন।
চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর অঞ্চলে স্বাধীনতাযুদ্ধে মেজর ওসমানের সাথে তাঁর স্ত্রীও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই তেজস্বী মহিলা অশেষ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সাহসী এই বীরের স্ত্রী বেগম ওসমান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন। একদিকে তিনি স্বামীকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিতেন, অন্যদিকে ইপিআর জওয়ান ও মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতেন। নিজের হাতে রান্না করে তিনি যুদ্ধশিবিরে পাঠিয়ে দিতেন।
১ এপ্রিল রাতে আমরা গোলক মজুমদারসহ একটা পুরনো রাশিয়ান বিমানে দিল্লি রওনা হই। ২ এপ্রিল সকালে দিল্লিতে পৌঁছাই। সেখানে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদের দুটি বৈঠকে অনেক বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তখনো ক্যান্টনমেন্টে প্রায় অবরুদ্ধ। ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ও কামান-বন্দুকের নাগালের বাইরে পুরো বাংলাদেশ স্বাধীন। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা তারা কয়েকদিনের মধ্যেই ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে। ফলে নিরীহ, নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন বৃদ্ধি পাবে। প্রথমত, মুক্তিযোদ্ধাদের (অর্থাৎ সক্রিয় অংশগ্রহণকারী, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ও ইপিআরের বাঙালি অফিসার, সিপাহি, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, যুবক, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যারা এরই মধ্যেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাদের) আশ্রয়, অস্ত্র ট্রেনিং ও পুনর্মিলনের (রিগ্রুপিং) সুযোগ করে দেওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ এসবের জন্য ভারতে আমাদের আশ্রয় প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, শরণার্থীদের (যার সংখ্যা এক কোটিতে দাঁড়াতে পারে) আশ্রয় ও খাদ্যের সুব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও মুক্তির দাবিতে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি। চতুর্থত, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ভারতে বাংলাদেশের একটি বেতার চালু এবং এর নির্বিঘ্ন প্রচারের সুবিধা ও সর্বোপরি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের স্বাধীনতা ও স্বীকৃতি আদায়ের জন্য জোর কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা।
উপরোক্ত এজেন্ডাগুলোর আলোকে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে এ আলোচনা বেশ ফলপ্রসূ হয়েছিল। এই আলোচনার পর দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে আমাদের সরকার আত্মপ্রকাশ করে। ১০ এপ্রিলে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি হয় এবং ১৭ এপ্রিল ওই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মুজিবনগর সরকার শপথবাক্য পাঠ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মুশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কামরুজ্জামান ও মনসুর আলীকে অন্যান্য মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
এম আমীর-উল ইসলাম : মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও আইন বিশেষজ্ঞ