একাত্তরের মার্চ
যেন এক অনন্ত যাত্রা (প্রথম কিস্তি)
(১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোর দীর্ঘ স্মৃতিচারণা করেছেন তৎকালে মুক্তিযুদ্ধকে কাছ থেকে দেখা ও সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। এনটিভি অনলাইনের জন্য লেখা সেই স্মৃতিচারণা ধারাবাহিকভাবে তিন কিস্তিতে ছাপা হবে। আজ ছাপা হচ্ছে এর প্রথম কিস্তি।)
’৭০-এর নির্বাচন
১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এলএফও (LFO=Legal Framework Order) জারি করেন। এলএফও যেভাবে তৈরি হয়েছিল তাতে নির্বাচনের পর একক সংখ্যাগরিষ্ঠরাই একটা নির্বাচিত সংসদ হিসেবে সংবিধান তৈরি করতে পারবেন। এ ক্ষমতাটা যেহেতু একটি নির্বাচিত সংসদকে দেওয়া হচ্ছে সে জন্য বলা যায়, এটা সত্যি এ আন্দোলনের একটা বড় বিজয় ছিল জনগণের।
পূর্ব থেকে তিনটি ধারায় বিভক্ত মুসলিম লীগ (মুসলিম লীগ কাইয়ুম, মুসলিম লীগ কনভেনশন ও মুসলিম লীগ কাউন্সিল) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে তাদের চরম ভরাডুবি ঘটে। জামায়াতে ইসলামী পৃথকভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় এবং এরাও জাতীয় পরিষদে কোনো আসন লাভ করতে ব্যর্থ হয়। বলা যায়, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সামনে শক্তিশালী কোনো দল বা মোর্চা ছিল না। গোটা বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নেয় এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে গণরায় প্রদান করে। জাতীয় পরিষদে প্রদত্ত ভোটের ৭৫.১০% আওয়ামী লীগ পায় এবং পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। জাতীয় পরিষদে সমগ্র পাকিস্তানের ৩১৩ (১৩টি মহিলা আসনসহ) আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসন পায়।
নির্বাচনের পর ৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু জনসভার প্রারম্ভে নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ গ্রহণ করান। এ ধরনের গণশপথ পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যতিক্রমী ঘটনা। এর কিছুদিন পর নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংবিধান রচনার জন্য আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল একটি সাবকমিটি গঠন করে। দলের নির্দেশ অনুযায়ী সংবিধান রচনার কাজ শুরু হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপনেতা নির্বাচন করা হয়। এ সভায় অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে চিফ হুইপ, টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নান ও আমাকে হুইপ নির্বাচিত করা হয়।
অসহযোগ আন্দোলন
পাকিস্তানের একটা খসড়া সংবিধানের কাজ এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। ড. কামাল হোসেন ও আমি মূলত সংবিধানের খসড়া তৈরির মূল দায়িত্ব পালন করি। অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে ড. নুরুল ইসলাম, ড. মোশাররফ হোসেন, রেহমান সোবহান, স্বদেশ বোস ও আনিছুর রহমানের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়। পহেলা মার্চ সকালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ৬ দফাভিত্তিক রচিত সংবিধানের খসড়া পেশ করা হয়। সকালের বৈঠকের পর হোটেল পূর্বাণীতে বিকেলের বৈঠকের স্থান ধার্য করা হয়। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সময় বেলা ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান বেতারে প্রচারিত এক ঘোষণায় ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। বাংলার মানুষকে বিকল্প পন্থা বেছে নেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য এই একটি ঘোষণাই ছিল যথেষ্ট।
ঢাকা শহরের সব শ্রেণীর মানুষ এ ঘোষণার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। জনতার জোয়ারে ভেসে যায় ঢাকার প্রতিটি অলিগলি রাজপথ। মিছিলকারী জনতার হাতে ছিল বিভিন্ন ধরনের লাঠি ও লোহার রড। জনতার কণ্ঠে মুখরিত হতে থাকে- ‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা’; ‘তুমি কে আমি কে-বাঙালি বাঙালি’; ‘ছয় দফা না এক দফা-এক দফা, এক দফা’; ‘পিণ্ডি না ঢাকা-ঢাকা, ঢাকা’; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। আন্দোলনের তোপের মুখে ঢাকা স্টেডিয়ামে চলমান টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ বন্ধ হয়ে গেল। ক্রীড়ামোদী দর্শকরা স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে এসে স্বতঃস্ফূর্ত জনগণের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। সারা শহর থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল পল্টন ময়দানে এসে জমায়েত হচ্ছে। পল্টনের সভায় বক্তৃতা করেন ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান প্রমুখ।
আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের পক্ষ থেকে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়। তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে গণ্য হবে। মুহুর্মুহ গগনবিদারী স্লোগানে মুখরিত এবং মিছিলে পরিবেষ্টিত পূর্বাণী হোটেল। অন্যদিকে পল্টন ময়দানে উপচে পড়া মানুষের ভিড়। ছাত্রদের নেতৃত্বে বিরাট জনসমাবেশ। সামরিক বাহিনীর গুলিতে শহিদ তিনজনের জানাজাও অনুষ্ঠিত হবে এখানে।
এদিকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে টেলিফোনে হোটেল কর্মকর্তাদের কাছে হুমকি আসছে ট্যাংক/কামান দিয়ে পূর্বাণী হোটেল উড়িয়ে দেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধু আমাকে হুইপ হিসেবে প্রথম দায়িত্ব দিয়েছিলেন এই মিটিংয়ের সবকিছু পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার। আমি একটা প্রস্তাবের খসড়া রচনা করে বঙ্গবন্ধুর হাতে দেই, সেটা তিনি অনুমোদন করার পর আমি পাঠ করি। করতালির মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়।
এ রকম একটি টানটান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আমি একটা প্রস্তাব লিখে ফেললাম। এর সারমর্ম ছিল, পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাংবিধানিক রীতিনীতি ও শিষ্টাচার ভঙ্গ করে কোনো আলাপ-আলোচনা ব্যতীত বেতারের মাধ্যমে ৩ মার্চ (১৯৭১) অনুষ্ঠিতব্য গণপরিষদের সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করায় এ সভার পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করছে এবং সেই সাথে পরিবর্তিত এ অবস্থায় উপস্থিত জনপ্রতিনিধিরা গণপরিষদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করছে এবং তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা-ই এই সর্বোচ্চ পরিষদের সিদ্ধান্ত হিসেবে পরিগণিত হবে।
বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং রোডের বাড়ির নিচতলার লাইব্রেরিতে টাস্কফোর্সের অফিস করা হয়েছিল। আমি টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে (১ মার্চ-২৫ মার্চ ’৭১) সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সংগঠকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া নির্দেশ সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কি না, বিভিন্ন জেলা, মহকুমা ও থানাতে স্থানীয়ভাবে কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে কি না এসব বিষয় রিপোর্ট আকারে বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া এবং পরবর্তী নির্দেশনামার একটি খসড়া তৈরি ছিল আমাদের কাজ। আমাদের এই টাস্কফোর্সের নেতৃত্ব দিতেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাঁকে সহায়তা করতাম ড. কামাল হোসেন ও আমি। বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করে আমরা প্রতিদিনের নির্দেশনা তৈরি করতাম। আমাদের একটা পরিকল্পনা ছিল যে, যখনই মিলিটারি টেক ওভার হবে, তাজউদ্দীন ভাই, কামাল হোসেন ও আমি যে যেখানেই থাকি আমরা তৎক্ষণাৎ একত্রিত হব এবং আমাদের কী করণীয় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। আমি এটাও জানি যে, এটা একটা স্নায়ুযুদ্ধ। একটি পর্যায়ে দুই পক্ষের এক পক্ষকে সেই অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্তটি নিতে হবে।
২ মার্চ, ১৯৭১ থেকে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। অসহযোগ আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগে হাইকমান্ড নামে একটা পাওয়ার স্ট্রাকচার গড়ে ওঠে। হাইকমান্ড দলের একজন প্রেসিডেন্ট, তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং দুজন জেনারেল সেক্রেটারিকে (একজন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সম্পাদক, একজন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) নিয়ে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগই ছিল মূলধারা। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মোশতাক আহমেদ, মনসুর আলী এ তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামরুজ্জামান দুজন সাধারণ সম্পাদক এই ছয়জনকে নিয়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড গঠিত ছিল এবং এঁরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। এরাই ছিলেন কার্যত সরকার বা মন্ত্রিসভা।
৩ মার্চ ছাত্রলীগ আয়োজিত পল্টনের বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় দেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা, ট্যাক্স প্রদান বন্ধ রাখার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ সংগীতকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তা ছাড়া সেদিনের সভা মঞ্চে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
৭ মার্চের ভাষণ
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। তিনি নিজেই বলেছেন ৭ মার্চে রেসকোর্সের জনসভায় গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। এ দিন বিভিন্ন দেশ থেকে বহু সাংবাদিক বাংলাদেশে আসেন। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ৬৭৭ নম্বর বাড়ি সংগ্রামের সূতিকাগারে পরিণত হয়। সকালে-বিকেলে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এ বাড়িতে এসে ভিড় জমান। তাঁরা সুযোগ পেলেই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিভিন্নভাবে আন্দোলন ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চান।
এ দিনকে কেন্দ্র করে পাকবাহিনীও সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিল অর্থাৎ সেনাবাহিনীরও একটা প্রস্তুতি ছিল ৭ মার্চ বিষয়ে। শোনা যায়, রেসকোর্সের জনসভাকে লক্ষ্য করে ঢাকা সেনানিবাসে কামান বসানো হয়। বঙ্গবন্ধু যদি এ দিন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তাহলে জনসভায় গোলা বর্ষণ করা হবে। সেজন্য ছত্রী সৈন্য প্রস্তুত রাখা হয়।
৭ মার্চের ভাষণের প্রস্তুতি চলে কয়েকদিন ধরে। বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের বিষয়, আন্তর্জাতিক বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয়কে তাঁর ভাষণে উল্লেখ করবেন বলে বিবেচনা করছিলেন। ভাষণে বিষয়বস্তু কী হবে এ নিয়ে অনেকেই মতামত দিয়েছিলেন। ১ থেকে ৭ মার্চে প্রতিদিন একটার পর একটা ঐতিহাসিক পরিবর্তন হতে থাকে, যেন ইতিহাসের চাকা খুব দ্রুত সামনের দিকে এগোচ্ছিল।
বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘তোমার মনে যা আসে ভাষণে তুমি তাই বলবে।’ আমি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম, আপনি আপনার বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে একা একা যা ভাবেন তাই আপনি বলবেন। হাজি গোলাম মোর্শেদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সব কাজের সাহায্যকারী। তিনি বঙ্গবন্ধুর গাড়ি চালিয়ে তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন। ১ মার্চেও তিনি গাড়ি চালিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পুরানা পল্টন অফিস থেকে পূর্বাণী হোটেলে নিয়ে আসেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু বসেছিলেন গাড়ির সামনের আসনে। আর পেছনে ছিলাম ড. কামাল হোসেন ও আমি। ৭ মার্চে হাজি গোলাম মোর্শেদ তাঁর গাড়িতে করে ৩২ নম্বর থেকে রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে আসেন। গাড়ি চালিয়ে আসতে আসতে পথে হাজি মোর্শেদ এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘নেতা, আপনি আজ কী বলবেন।’ তিনি উত্তরে বলেন, ‘আল্লাহ আমার মুখ দিয়ে যা বলাবেন তাই বলব।’
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু অপার্থিব শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এক অনন্যসাধারণ ও অলৌকিক বক্তৃতা দেন। অমর সেই ভাষণের একাংশে তিনি বলেন :
‘আর যদি একটি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। ... ... সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না। .... রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের শেষ বাক্যটি ছিল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ বাক্যের মাধ্যমে তিনি যে বার্তা দিলেন সেটা প্রতিটি বাঙালি, ছাত্র, কৃষক, জনতা, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, কেরানি, গৃহিণী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ, ইপিআর, বাঙালি সৈনিক, সেনাবাহিনীর অফিসার সবার জন্য একটা দ্ব্যর্থহীন আদেশ হিসেবে গণ্য হলো। তিনি বলেছিলেন ‘আর যদি একটি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল প্রত্যেকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ কোনো ব্যক্তির বুঝতে বাকি রইল না যে তিনি স্বাধীনতার অমর বাণীটি উচ্চারণ করেছেন। কবির ভাষায়- ‘সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলো’। এ ভাষণে তিনি জনগণকে ‘সব রকম’ প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন। ফলে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অন্তরালে ছিল একটি সুচিন্তিত ও সুদূরপ্রসারী রণকৌশল।
ওরই মধ্যে লক্ষ করলাম, বঙ্গবন্ধু আত্মশক্তিতে আরো বেশি বলীয়ান হয়ে উঠেছেন, যেন কোনো অলৌকিক স্বত্তায় রূপান্তরিত হয়েছেন তিনি। সারা দেশের মানুষের প্রাণঢালা ভালোবাসা ও সমর্থন তাঁকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছে। তখন তাঁর প্রতিটি কথাই ছিল বাঙালির মনের কথা। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতাকে আব্রাহম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সাথে তুলনা করেন। কিন্তু আমি মনে করি এ বক্তৃতার কোনো তুলনা নেই। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের আগে ও পরে অসংখ্য বক্তৃতা করেছেন। ৭ মার্চের বক্তৃতার সাথে তাঁর অন্য কোনো বক্তৃতার তুলনা হয় কি? ৭ মার্চের বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাই আমি মনে করি, ৭ মার্চের বক্তৃতা এক অনন্য বক্তৃতা, যার সাথে পৃথিবীর অন্য কোনো বক্তৃতারই তুলনা চলে না। বাঙালি জাতি যত দিন বিশ্বের বুকে বেঁচে থাকবে তত দিনই এই বক্তৃতার প্রাসঙ্গিকতা থাকবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই ভাষণের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া মূল্যবোধ দ্বারা আলোড়িত ও প্রভাবিত হবে। বাঙালি জাতির জীবনে এ বক্তৃতা এক অক্ষয়, অমর ও চির অম্লান চেতনায় সমৃদ্ধ এক স্বতঃস্ফূর্ত অভিভাষণের স্মারক হয়ে থাকবে।
৭ মার্চের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের নয়া কর্মসূচি ঘোষণা করেন। দেশের সর্বত্র শহরে-বন্দরে-নগরে-গ্রামে-গঞ্জে পাকিস্তানি শোষণ, ষড়যন্ত্র, নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনসভা, বিক্ষোভ মিছিল ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। এ নির্দেশের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সর্বময় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একাত্তরে শাহরিয়ার ইকবাল ঢাকায় প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণের দিন পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদের কাছাকাছি বসে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনেন।
শাহরিয়ার ইকবাল লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালে ৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন ঢাকার ডেপুটি কমিশনার এ টি এম শামসুল হক এবং সদর এসডিও এম নুরুজ্জামান আমাকে ওই সভায় উপস্থিত থাকার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন। রেসকোর্সের ম্যানেজারের বাসা ছিল একটি টিলার ওপর। নিচে ছিল ঘোড়ার আস্তাবল। এখানে এখন পুলিশ কন্ট্রোল রুম। আমরা টিলার ওপর অবস্থান নিয়েছিলাম। রেসকোর্স ম্যানেজারের বাসা থেকে কয়েকটি কাঠের চেয়ার আমাদের বসার জন্য দেওয়া হলো। ডিসি, এসডিও ও আমি সেখানে বসলাম। নিচে বিশাল জনতার ঢল। বঙ্গবন্ধু মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য উপস্থিত হবেন। কিছুক্ষণ পর দেখলাম একটি খোলা জিপে একজন সিনিয়র আর্মি অফিসার আসলেন। ড্রাইভ করছিলেন একজন আর্মি ক্যাপ্টেন। পেছনের সিটে দুজন অস্ত্রধারী আর্মি জওয়ান। এসডিও নুরুজ্জামান সাহেব জানালেন, এই ব্যক্তি হচ্ছেন পাকিস্তান আর্মির সর্বাধিনায়ক, জেনারেল হামিদ। তিনিও এসে বসলেন একটি কাঠের চেয়ারে। অদূরে আর্মির ওয়্যারলেরে জওয়ানরা কথা বলছিল পাঞ্জাবি ভাষায়। ১৯ মিনিটের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু সেদিন ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধু সেদিন অন্য কোনোভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে ওপর থেকে এয়ারফোর্সের বিমান গুলিবর্ষণ করে লক্ষ জনতাকে নিহত করত। তিনি জাতিকে এমনভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনালেন যে জনতা ঠিকই বুঝল, কিন্তু পাকিস্তানি জেনারেল সাহেব কিছুই করতে পারলেন না। রাজনৈতিক সভার Long-hand notes নেন এস বি ও দুজন সাব-ইন্সপেক্টর। সেই নোট Attest করতে হয় একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটকে। মিটিং শেষ হওয়ার সাথে সাথে দুজন এসবি সাব-ইন্সপেক্টর Attestation-এর জন্য আমার কাছে এলেন। আমি সত্যায়িত করলাম। তখন বুঝতে পারি নাই ইতিহাসের অন্য একটি ‘Magna Carta’ আমি সত্যায়ন স্বাক্ষর করলাম।’
ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট শাহরিয়ার ইকবাল ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানে মঞ্চের খুব কাছেই যে টিলাটির বর্ণনা দিয়েছেন সেখানে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ছাড়াও উপস্থিত ছিল সাধারণ পোশাকে একটি চৌকস কমান্ডো বাহিনী যা আমরাও প্রত্যক্ষ করেছি।
প্রকৃতপক্ষে পহেলা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারা বাংলাদেশ পরিচালিত হতে থাকে। আমরা বুঝতে পারছিলাম যে, অসহযোগ আন্দোলন ধীরে ধীরে একটি সশস্ত্র যুদ্ধে পরিণত হতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। জনযুদ্ধের একটা যথার্থ ও যুক্তিগ্রাহ্য প্রেক্ষাপট তিনি রচনা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও জনসম্পৃক্ততার বিষয়টি বঙ্গবন্ধু যথাযথভাবে উপলব্ধি করেছিলেন।
একাত্তরের উত্তাল মার্চ
ওই সময়ের উত্তাল মার্চে দেশের অবস্থা, আন্দোলনের গতিধারা প্রতিদিন নতুন নতুন মোড় নিচ্ছে, যার পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে সে সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলোতে চোখ বুলালে নতুন প্রজন্মের পাঠকরা উপলব্ধি করবেন সেদিন সে কী এক মহাকাব্য রচনা করার জন্য সারা জাতি এক অখণ্ড চেতনার সুনির্দিষ্ট বিন্দুতে মিলিত হয়েছিল। সেই দিনগুলোর প্রতিটি ঘটনার অন্তর্নিহিত ইঙ্গিত ছিল একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করছিলেন। একটি নির্দিষ্ট পরিমাপে বিক্রিয়ার ফলে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন একত্রিত হলে জলধারায় পরিণত হয়, আর সেই জলধারা খরস্রোতা হলে তা হিমালয়ের পাথর ভেঙে নিজস্ব পথ তৈরি করে নেয়। সেদিন বঙ্গবন্ধু প্রতিটি মানুষকে তেমনি এক ইস্পাত কঠিন অঙ্গীকারের শপথে ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই দিনগুলোর নমুনা বোঝার জন্য সংবাদপত্র থেকে নিচে কয়েকটি শিরোনাম তুলে ধরছি :
দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ মার্চ, ১৯৭১
হরতাল : কারফিউ ভঙ্গ : হরতাল
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার প্রতিবাদে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের মহানায়ক আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সংগ্রামী বাংলার রাজধানী ঢাকা নগরী গতকল্য (মঙ্গলবার) প্রচণ্ড গর্জনে ফাটিয়া পড়ে। সর্বাত্মক হরতাল-কবলিত নগরী সারাদিন যেন মিছিলের নগরীতে পর্যবসিত থাকে। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের গণমানুষের এই নজিরবিহীন সার্বিক হরতালের দরুন রাজধানীতে গতকাল একদিকে চূড়ান্ত অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়, অপরদিকে ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের অবিস্মরণীয় দিনগুলির স্মৃতিকে ম্লান করিয়া দিয়া রাজপথে জনপদে নামিয়া আসে আদিহীন অন্তহীন জনতার স্রোত। ...
দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ মার্চ, ১৯৭১
৩ মার্চ এক জনসভায় শেখ মুজিব বলেন, ‘ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত কর খাজনা বন্ধ’
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রতিবাদে ঘোষিত কর্মসূচি পালনের দ্বিতীয় দিবসে গতকল্য ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানের উত্তাল উদ্দাম, বিশাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে ভাষণ দানকালে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বিগত দিনের ঘটনাবলীর পটভূমিতে বিচার করিয়া তুমুল করতালির মধ্যে সামরিক সরকারকে অবিলম্বে গণপ্রতিনিধিদের হস্তে ক্ষমতা সমর্পণ করিয়া ব্যারাকে ফিরিয়া যাওয়ার আহ্বান জানাইয়া জলদগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করেন : বাংলার গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা সমর্পণ করিয়া ব্যারাকে ফিরিয়া না যাওয়া পর্যন্ত সরকারের সহিত স্বাধিকারকামী বাংলার মানুষ আর সহযোগিতা করিবে না, কোনো কর-খাজনাও দিবে না। ...... ভুট্টোদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান, আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারাই রচনা করুন, বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করিব।” ...
দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ মার্চ ‘৭১
৭ কোটি বাঙালি যেখান হইতে আজ নির্দেশ গ্রহণ করবে
ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষ ক্ষমতা হস্তান্তর না করিলেও বিশ্ববাসীর কাছে আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, বাংলার শাসনক্ষমতা এখন আর সামরিক কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারে নাই। বরং ৭ কোটি মানুষের ভালোবাসার শক্তিতে ধানমণ্ডির ৩২ নং সড়ক এখন বাংলার শাসনক্ষমতার একমাত্র উৎস হইয়া পড়িয়াছে। হাজার চোখ রাঙানি সত্ত্বেও এই সড়ক হইতে যে নির্দেশ জারি হয়, বাংলার ৭ কোটি মানুষ এখন যেকোনো মূল্যে তাহা বাস্তবায়ন করেই। আর যাহার নির্দেশ জনগণ পরম শ্রদ্ধায় ও চূড়ান্ত ত্যাগের বিনিময়ে কার্যকরী করে তিনি হইতেছেন বাংলার মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিব এখন বাংলার মুক্তিসংগ্রামের জীবন্ত প্রতীক। এই জন্যই ধানমণ্ডিস্থ শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন এখন একটি অঘোষিত সরকারি সদর দফতরে পরিণত হইয়াছে। হোয়াইট হাউস বা ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট-এর মতো এই বাড়িটির কোনো সরকারি মর্যাদা নাই বটে- কিন্তু বাংলার সাত কোটি মানুষের ভালোবাসার রাজ্যে এই বাড়ি এক অনন্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত।
দৈনিক আজাদ, ১৫ মার্চ ’৭১
বাংলার মানুষ শুধু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশই গ্রহণ করিবে
স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে গতকাল সোমবার বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এক বিরাট সমাবেশে ১১৫ নং সামরিক আইনের নির্দেশকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যানপূর্বক ঘোষণা করা হয় যে, বাংলার মানুষ এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যতীত অপর কাহারও নির্দেশ মানিয়া চলিবে না। ...
দৈনিক আজাদ, ১৭ মার্চ, ১৯৭১
ঢাকা হাইকোর্ট বার সমিতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশই পালন করিবেন
ঢাকা হাইকোর্ট বার সমিতি এক সভায় আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যেকোনো সিদ্ধান্ত আন্তরিকতার সহিত গ্রহণ এবং তাঁহার বর্তমান নির্দেশসহ অদূর ভবিষ্যতে বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে জারীকৃত যেকোনো নির্দেশ মানিয়া চলার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ... ... সভায় গৃহীত কতিপয় প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের সহিত একাত্মতা ঘোষণা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪ দফা পূরণে জোর দাবি জানানো হয়।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ মার্চ ’৭১
The Times of India, Saturday March 27, 1971
A `sovereign independent People’s Republic of Bangladesh’ was proclaimed by Sheikh Mujibur Rahman today even as President Yahya Khan ordered the army to fully restore the authority; of his Government in the turbulent eastern wing.
The Declearation broadcast over `voice of Independent Bangladesh, said: `The Sheikh has decleared the 75 million people of East Pakistan citizens of Independent Bangladesh’.
২৫ মার্চ এবং অজানা পথে
২৫ মার্চ, ১৯৭১। একটি ভয়াল রাত, বাঙালির ঐক্যবদ্ধভাবে ঘুরে দাঁড়াবার একটি চরম মুহূর্ত। এত বছর পর এ সময়ের স্মৃতিচারণা একটু কঠিন এবং কষ্টকরও বটে। এখনো ওই সময়ের স্মৃতি মনে করলে আমার অদ্ভুত অনুভূতির কথাটি মনে পড়ে। ২৫ মার্চের রাতে পাক বাহিনীর ছোড়া কামান ও বোমার আলোতে ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে, মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর রাত যেন এক অশুভ আলোয় ঢাকা পড়ে আছে। আর এরই মধ্য থেকে যেন একটি নতুন বাংলাদেশ জন্মগ্রহণ করছে।
২৭ মার্চ আমরা ঢাকার সীমানা পার হয়ে যাই। ফলে পাক বাহিনীর গোলার বাইরে চলে এসেছি আমরা। মুক্তাঞ্চলে তাজউদ্দীন আহমদ ও আমি হেঁটে চলেছি বিরতিহীন। দেখেছি মানুষের চোখে মুখে ক্ষোভ, তবে অন্তরে প্রতিরোধের দৃঢ় মনোবল। এই যুদ্ধ যেন মানুষের দৃষ্টিকে বদলে দিয়েছিল এক অলৌকিক ছোঁয়ায়, আমরা সবাই এক অনিশ্চিত ও অজানা গন্তব্যের দিকে ধাবমান তবুও কাউকে সাহস হারাতে দেখিনি। আমরা সম্বলহীন ছিলাম তবুও অসহায়ত্বের কোনো বেদনা আমাদেরকে যেন সেদিন স্পর্শ করতে পারেনি। সবার মধ্যে ছিল এক প্রচণ্ড ক্ষোভ, সম্মিলিত এক সুতীব্র ঘৃণা এবং প্রত্যেকের চোখেমুখে ছিল যেকোনো বাধাকে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়াবার হিমালয়সম অটল সংকল্প। এ অবস্থা দেখে তাজউদ্দীন আহমদকে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলাম, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, আমাদের আর কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
হাটবাজার, পুলিশ, প্রশাসন সবকিছু আমাদের সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে চলছে। সংগ্রাম পরিষদ অস্ত্র ও গোলাবরুদসহ সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। ১ মার্চ ’৭১ থেকে কার্যত (de facto) যে সরকার সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার নির্দেশেই সবকিছু চলছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি আন্তরিক আনুগত্য অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর সরকার মানুষের অন্তরাত্মায় ঢুকে গেছে।
তাঁরা বলছেন, এখন স্বাধীন বাংলার সরকার দরকার। কারণ এরই মধ্যে আর্মড ফোর্স, পুলিশ, ইপিআর বিদ্রোহ করেছে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছিল তাদের নেতৃত্বে স্থানীয়ভাবে কাজ করবার অভ্যাসটি ৭ মার্চের পর থেকেই সংঘবদ্ধ প্রতিরোধে রূপ নিয়েছে। ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত সবার দাবি সরকার গঠন কর। পথে চলতে গ্রামেগঞ্জে হাটে লোকালয়ে আমাদের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যেও একই মনোভাব। কোথাও এর কোনো ব্যত্যয় লক্ষ করিনি। সবার সঙ্গে আলোচনা করে আমরা এই উপলব্ধিতে ও সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে এ মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম একটি কার্যকর ও বৈধ সরকার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
ওই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর একটা কথাটা আমার বারবার মনে পড়ছিল। তিনি বলেছিলেন, আমি সব তৈরি করে রেখে যাব। দৃশ্যত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আর ঢাকার মানুষের চলাচল গণমিছিলের মতো গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে, ছড়িয়ে পড়ছে নিজ নিজ এলাকায়। নিজ দেশের মাটিতে, নিজ শহর ও রাজধানী থেকে তারা বিতাড়িত হয়ে প্রতিটি মানুষ এক একটি বিস্ফোরন্মুখ আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়েছে। দেশের মাটিকে খাঁটি জেনে প্রাণপণ লড়াইয়ের মানসিক প্রস্তুতি তাদের চোখেমুখে দৃপ্ত। কান্না নেই, হাহাকার নেই। নীরব প্রতিবাদ আর প্রত্যয় সুদৃঢ় মুখাবয়ব, প্রতিটি মানুষই এক একজন বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি। এমন দৃশ্য সংবলিত কোনো ছবি আমি পৃথিবীর কোনো গ্যালারিতে, কোনো শিল্পীর ছবিতে দেখিনি । Exodus-নামে একটা ছবি দেখেছিলাম অনেক আগে। সেই ছবি দেখে আত্মবিচ্ছিন্নতার বা নিজের অস্তিত্ব থেকে মূলোৎপাটিত হওয়ার এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল আমার। আজ হঠাৎ করে মহাকালের এক অনিবার্য ঘূর্ণাবর্তে আমি নিজেও যেন আরেক Exodus-এর মিছিলে শামিল হয়ে গেছি। অবশ্য এই এক্সোডাস নিজের মাটি ও মানুষের টানে। মাইলের পর মাইল যত দূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত মানুষের মিছিল। প্রতিটি মানুষ ঘামের গন্ধের আত্মীয়তায় একে অপরের সাথে মিশে গেছে। প্রতিটি মানুষের লক্ষ্য আজ এক ও অভিন্ন। এখন পদ্মা মেঘনা যমুনার নিস্তব্ধ গর্জন প্রতিটি মানুষের অন্তর মোহনায় আছড়ে পড়ার এক নিঃশব্দ উচ্চারণ তাদের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে শুনতে পাচ্ছি। ওদের পাশাপাশি একই মিছিলে আমরা হাঁটছি মাইলের পর মাইল। ঢাকা শহরটা আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। শত্রু বিতাড়িত বিজয়ী মুহূর্তে জেগে ওবার অপেক্ষায় দিন গুনছে আমাদের পরিবার পুত্র-কন্যা সবাই।
বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর নানা কথায়, ৭ মার্চের ভাষণে প্রদত্ত তাঁর বার্তা সবকিছুরই যেন আজকে আমি প্রতিফলন দেখছি চারপাশে। নয় মাসের যুদ্ধের পুরো সময় আমরা তা দেখেছি। পথ চলতে চলতে দেখেছি, আওয়ামী লীগ পরিচালিত সংগ্রাম পরিষদ সবকিছুর কন্ট্রোল নিয়ে নিয়েছে। ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলন এবং এ সময়ে গঠিত আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড পরিচালিত একটি কার্যকর সরকার ২৫ মার্চের পরও চলছে। বুঝলাম, বাংলাদেশ সরকার মানুষের অন্তরে ঢুকে গেছে। সে সরকার হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সরকার। খবর পাচ্ছি, গেরিলা যুদ্ধ সর্বত্র শুরু হয়ে গেছে। প্রতিটি সবল দেহের তরুণ হলো এই যুদ্ধেরও মূল শক্তি, তাদের জন্য অনিঃশেষ প্রেরণা উৎস হিসেবে কাজ করেছে তাদের মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, পরিবার প্রতিবেশী সবাই। গ্রাম থেকে গ্রামান্তর নদী-খাল-বিল পেরিয়ে মাঠ ছাপিয়ে বিস্তৃত জনপদ আজ এক বিরতিহীন মিছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের প্রতিটি বাণী গ্রামে, গঞ্জে, হাটে, শহরে, উপশহরে ছড়িয়ে পড়েছে মুহূর্তের মধ্যে।
(চলবে)
এম আমীর-উল ইসলাম : মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও আইনবিশেষজ্ঞ