সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ কোনো দেশেই কার্যকর হতে পারছে না
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেছেন, সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ কোনো দেশেই কার্যকর হচ্ছে না।
আজ বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগের উদ্দেশে এই মন্তব্য করেন আমীর-উল ইসলাম।
‘সারা দুনিয়াজুড়ে আমরা যে অবস্থা দেখছি, তাতে বিচারকদের অসদাচরণের কোনো ঘটনা যদি ঘটে, তাহলে সেটি জুডিশিয়ারি ঠিক করবেন। সেটিই হবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’, আদালতকে বলেন জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী।
‘আমাদের এখানেও সে রকম একটা পদ্ধতি চালু আছে, যা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। সুতরাং, তারাই এটি বিবেচনা করবেন। পার্লামেন্টারি রিমুভাল (সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ) কোনো দেশেই কার্যকর হতে পারছে না। ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়াতেও। সেখানে আরো বেশি বিতর্কের সৃষ্টি হয় এ নিয়ে’, যোগ করেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।
আদালতে বক্তব্য শেষে জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তাহলে জুডিশিয়ারির তদন্ত হবে এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন।’
‘এখানে আন্তর্জাতিকভাবে যে সমস্ত আইন-কানুন রয়েছে, জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ইউরোপ বা কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে যে সমস্ত রুলস দেখা যাচ্ছে, সব জায়গায় এখন জুডিশিয়ারি যে কম্পিট্যান্স এবং তাদের যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট এবং তাদের যদি কোনো ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনের প্রয়োজন হয়, ওইটাও তারা নিজেরাই করবেন।’
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের যে সমস্ত অভিজ্ঞতা আছে, সেগুলো আমি তুলে ধরেছি। এখন এটির বিবেচনার বিষয় আদালতের।’
‘বাহাত্তরের সংবিধানের প্রণয়নের সময় আপনারা এটি সংসদের হাতে কেন দিয়েছিলেন’- এমন প্রশ্নের জবাবে এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘তখন তো আমরা জুডিশিয়ারি গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের প্রধান বিচারপতি কে হবেন সেটাও বঙ্গবন্ধু ফেরার পর ১০ জানুয়ারি, ১১ জানুয়ারি আমরা প্রধান বিচারপতি খুঁজছি। কাউকে তো শপথ নিতে হবে।’
এম আমীর-উল ইসলাম আজ দ্বিতীয় দিনের শুনানি শেষে বক্তব্য অসমাপ্ত রাখেন। বক্তব্য শেষে আদালত আগামী রোববার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি ঘোষণা করেন।
এর আগে গত ৮, ৯, ২১, ২২, ২৩ ও ২৪ মে এ মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় আপিল শুনানিতে সহায়তার জন্য ১২ আইনজীবীকে আদালতের বন্ধু (অ্যামিকাস কিউরি) হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাঁদের লিখিত বক্তব্য আদালতে জমা দিতে বলেন আপিল বিভাগ।
অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ১২ আইনজীবী হচ্ছেন—বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার আজমালুল হক কিউসি, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া ও এম আই ফারুকী।
বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করা হয়। পরে ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।
পরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।
এ আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ওই সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।
এ রুলের ওপর শুনানি শেষে গত ৫ মে আদালত সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে ১৬তম সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। তিন বিচারকের মধ্যে একজন রিট আবেদনটি খারিজ করেন।
এর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতের ভিত্তিতে রায় প্রকাশিত হয় গত বছরের ১১ আগস্ট এবং রিট খারিজ করে দেওয়া বিচারকের রায় প্রকাশিত হয় ৮ সেপ্টেম্বর। দুটি মিলে মোট ২৯০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। ওই আপিলের ওপর শুনানি চলছে।
হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র।
রায়ে আরো বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়, যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।