এনটিভিতে আমার সেইসব দিন
প্রতি বছরই বয়স বাড়ে। আমার মতো মানুষের বাড়ে, গাছপালার বাড়ে, অন্য প্রাণীর বাড়ে, প্রতিষ্ঠানের বাড়ে। এনটিভিরও বয়স বাড়ছে প্রতি বছর। প্রতিষ্ঠানের বয়স বাড়া আর মানুষের বয়স বাড়ার হিসাব এক নয়। আমাদের বয়স বাড়লে আমরা বুড়ো হই। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার আরও তরুণ হয়ে ওঠা উচিত।
আমি এনটিভিতে যোগ দিয়েছিলাম ২০০৬ সালের মার্চে। এর আগে কিছুদিন শিক্ষানবীশ হিসেবে ছিলাম বাংলাভিশনে। এনটিভিতে আমার চাকরি পাওয়ার ঘটনাটা কোনওদিন ভুলে যাওয়ার মতো নয়। তখন প্রায় একইসাথে তিনটি নতুন চ্যানেল তাদের যাত্রা শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এনটিভির বিভিন্ন শাখা থেকে তখন অনেকেই সেসব চ্যানেলে চলে গেছে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু (আমরা একই হলে থাকতাম) শাহেদ আলম তখন এনটিভির পর্দা কাঁপাচ্ছে। একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডায় সে আমাকে বলল, এনটিভিতে রিপোর্টার নিচ্ছে, তুমি ট্রাই করতে পারো। আমি রাজি হলাম।
পরের দিন সকালেই আমার ইন্টারভিউয়ের সময় নির্ধারিত হলো। আমি ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। একটা পোলো গেঞ্জি পরে গিয়েছিলাম। তখন পেন ড্রাইভের যুগ শুরু হয়েছে এবং সে পেনড্রাইভ গলায় ঝোলানো যেত। ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার সময় সেটাও আমার গলায় ঝুলছিল।
ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন তখনকার চিফ নিউজ এডিটর খায়রুল আনোয়ার মুকুল এবং এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হাসনাইন খুরশীদ। আমার ড্রেস-আপ দেখে শুরুতেই তাঁরা হতাশ হলেন। এমন ড্রেসে কেউ ইন্টারভিউ দিতে আসে কি না! এমন বিস্ময় ছিল তাঁদের চোখেমুখে। যা-ই হোক, ইন্টারভিউ শুরু হলো।
টানা ৪০-৪৫ মিনিট ধরে তাঁরা আমাকে নানা প্রশ্ন করলেন। কিন্তু একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারলাম না আমি। কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তা নিয়ে তারা নিজেরাও হয়তো দ্বিধায় পড়ে গেলেন। শেষ প্রশ্নে তাঁরা বললেন, ‘তুমি তো কিছুই পারো না। তাহলে তোমাকে কেন নেব?’ আমি বলেছিলাম, ‘আমি যে কাজটা করব, তা সততার সাথে করার চেষ্টা করব।’
তারপর কী যেন মনে করে হাসনাইন খুরশেদ শুচি ভাই আহারার হোসেনকে (বর্তমানে বিবিসিতে কর্মরত) ডেকে আমার ভয়েস টেস্ট করতে বললেন। আমি ভয়েস দিয়ে চলে গেলাম। সেদিন সন্ধ্যায়ই আমার চাকরি কনফার্ম হয়ে গেল। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আত্মবিশ্বাস এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে ইন্টারভিউতে কোনও কিছু না পারলেও কখনও কখনও চাকরি পাওয়া সম্ভব।
২০০৬ সালের সেই মার্চে যোগ দেওয়ার পর ২০১১ সালের মার্চে এনটিভি ছেড়েছি। এই পাঁচ বছরে একটা দুরন্ত জীবন রেখে এসেছি সেখানে। এনটিভি আমার প্রেম, ভালোবাসা, সংসার সবকিছু ছিল। একটা অফিস যে পরিবার হয়ে উঠতে পারে, তার প্রথম শিক্ষা আমাকে দিয়েছে এনটিভি।
এনটিভিতেই শিখেছিলাম কোনও কিছু জানতে হলে, দক্ষতা অর্জন করতে হলে নিজেকে আগে শূন্য মনে করতে হবে। যদি বলি এনটিভিতে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক আমার কাদের সাথে ছিল? তাহলে আমি গাড়িচালকদের কথা বলতে চাই। ক্যামেরাম্যান, ভিডিও এডিটর, নিউজ এডিটর, প্রোডাকশন টিম, কো-অর্ডিনেশন টিম সবার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আজকের মুনজুরুল করিম যদি তার কোনও কাজের জন্য পরিচিত হয়, তাহলে আমার এনটিভির আত্মীয়রা তার ভিত তৈরি করে দিয়েছে।
এনটিভিতে চাকরির পাঁচ বছরে আমি বাসায় যতটুকু সময় কাটিয়েছি, তার চেয়েও বেশি কাটিয়েছি অফিসে। অফিসে আমার জামা-জুতা থেকে শুরু করে টুথব্রাশ পর্যন্ত থাকত। চাকরিটাই তো এমন, যে কোনও সময় যে কোনও জায়গায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
আমি অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল, আমি হয়তো বিজনেস রিপোর্টিং করতে চাইব। কিন্তু আমি বেছে নিয়েছিলাম ক্রাইম রিপোর্টিং। কেন? কারণ, এর মাধ্যমেই মানুষের কাছে গিয়ে মানুষের কাজ করা যায়, এটাই আমার বিশ্বাস।
কত শত শত ঘটনা।
যেদিন নাইট ডিউটি থাকত, সেদিন কাজ শেষ করে বাসায় যেতে যেতে সকাল ৮-৯টা বেজে যেত। তারপর আবার ৩টা থেকে ক্রাইমে ডিউটি। কখনও নিজেকে ক্লান্ত মনে হয়নি। একদিন সব কাজ শেষ করে বিকেলের দিকে নিউজরুমের একটা কোনায় বসে কম্পিউটারে কী যেন করছি। যে কোনও সময় অফিস থেকে বেরিয়ে আসব। হঠাৎ করে শুচি ভাই পেছনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ওঠো। গাড়ি রেডি আছে, এখনই চট্টগ্রাম চলে যাও। সেখানে পাহাড় ধসে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। না যাওয়ার জন্য বললাম, আমি টি-শার্ট পরে আছি। সাথে কোনও জামাকাপড় নেই। কীভাবে যাব?
তিনি বললেন, চট্টগ্রামে পৌঁছে জামাকাপড় কিনে সরাসরি স্পটে চলে যাবা। সেই যে গেলাম। ঘটনার ভেতরে ঢুকে গিয়ে পরবর্তী কয়েক দিন আর কোনও কিছু মনে থাকেনি।
সেই সময়টাতে সব ডাকসাইটে সাংবাদিকেরা কাজ করতেন এনটিভিতে। মোস্তফা ফিরোজ, সুপন রায়, শামসুদ্দিন হায়দার ডালিমসহ আরও অনেকেই। নিউজে নিজের অবস্থান জানান দেওয়ার জন্য কী তুমুল প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে আমাদের!
এসবের ফলাফলও পেয়েছি। আমাদের একটা ব্যাচকে তখন বাংলাদেশের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে ‘সোনালি প্রজন্ম’ বলা হতো। হয়তো এখনও বলা হয়। একবার এক নিউজে আমার স্ক্রিপ্টে ইমোশন বেশি থাকার কারণে নিউজ এডিটর খুব বকাঝকা করলেন। তখনও মন এতটা শক্ত হয়নি। সিঁড়িতে বসে পুরো দুপুর কান্নাকাটি করলাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম চাকরি ছেড়ে দেব।
পদত্যাগপত্র নিয়ে নির্বাহী পরিচালকের কাছে গেলাম। তিনি সব শুনে বললেন, ধরো, তোমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হলো। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত তুমি ভালো একটা চাকরি না পাও, তত দিন এটা আমার কাছেই থাকবে। এভাবেই তাঁরা আমাকে, আমাদের তৈরি করেছেন।
এনটিভির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী তাঁর হাসির জন্য পরিচিত। ব্যবহারে তিনি বেশ বিনয়ী। তিনি যখন বিল্ডিংয়ের নিচে লিফটে উঠতেন, তখন সামনে অফিসের কাউকে দেখলে সাথে করে নিতেন। একবার আমরা কয়েক জন লিফটের জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি এলেন। এর মধ্যে আমাদের এক সহকর্মীর বাবাও অপেক্ষা করছিলেন তাঁর সন্তানের অফিস দেখার জন্য। তিনি (আমরা ফালু ভাই বলি) এসে পরিচয় জানলেন। তারপর তাঁকে সাথে নিয়ে অফিস পর্যন্ত গেলেন এবং তাঁর ছেলের অনেক প্রশংসা করলেন। এভাবেই একটা অফিসের সাথে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হয়। মানুষ প্রতিষ্ঠানকে আপন ভাবতে শুরু করে।
আমি যখন এনটিভিতে ছিলাম, তখন ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন এনায়েতুর রহমান বাপ্পী ভাই। এখন চ্যানেল নাইনের মালিক। ২০০৯ সালে আমি জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের খবর সংগ্রহের জন্য ডেনমার্কে যাচ্ছিলাম। সে বার বাজেটটা একটু বেশি হয়ে গেল। আমি ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে বাজেট নিয়ে গেলাম। তিনি বেশ কিছুক্ষণ বাজেটটা দেখে বললেন, দেখো, আমি এমডি হয়ে যদি কিছু না কাটি তাহলে কেমন হয়? এই কথা বলে তিনি মাত্র ১০ ডলার কেটে দিলেন। আহ! সেই এনটিভি।
এনটিভি এখনও তেমন আছে কি না জানি না।
এনটিভি ছাড়ার সময় ভেবেছি, কিছুদিন পর আবার ফিরে আসব। এনটিভি ছেড়ে থাকব কীভাবে! প্রতি বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যেতাম আমরা অনেকেই। মুকুল ভাইয়ের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটানোও একটা বড় উদ্দেশ্য থাকত।
তেমন একটা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ফালু ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। তখন আমি ইনডিপেনডেন্ট টিভিতে। তিনি বললেন, ‘অনেক হয়েছে। এবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসো। আমি সালমান ভাইকে তোমার কথা বলে দিচ্ছি।’ আমি বলেছিলাম, ‘আমরা মিডল ক্লাস। আমাদের একটা কমিটমেন্ট থাকে। এখন ফিরতে পারব না। তবে এনটিভি আমার কাছে নিজের বাড়ি, আর অন্য সবকিছু শ্বশুরবাড়ি।’
এ কথা শুনে তিনি আর কিছু বলেননি। এরপর আরও বহু বছর চলে গেছে। পরবর্তী সময়ে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনও আমার নিজের বাড়ি হয়ে উঠেছিল। এনটিভিতে ফেরা হয়নি।
বয়স বাড়তে বাড়তে আরও তরুণ হয়ে উঠুক এনটিভি। এটাই প্রত্যাশা।