নিভৃতচারী সুরসাধক এন্ড্রু কিশোর ও তাঁর অহংবোধ
রাজশাহীর মাটির ছাওয়াল এন্ড্রু কিশোর যে বেলায় সংগীতে ক্যারিয়ার গড়তে রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে নিজের আঁতুড়ঘর ছেড়েছিলেন, সে সময় স্কুল শিক্ষিকা মা মিনু বাড়ৈ না কি খুব কেঁদেছিলেন। মায়ের চেয়েও অধিক কান্না বুকে চেপে বিচিত্র শহর ঢাকায় পা রাখলেও জন্মস্থানের মায়া কোনোদিন ভোলেননি আমাদের প্রিয় কিশোর।
নিজের মাতৃভূমি রাজশাহীকে কেমন ভালো বাসতেন এই সুরের কবি? নিজের মৃত্তিকাকে কতটা আগলে রাখতেন? চলচ্চিত্রের প্লেব্যাকে ব্যস্ত সময় পার করলেও প্রতি তিন মাস অন্তর সাধের রাজশাহীতে ছুটে যেতেন তিনি।
খ্যাতির বিড়ম্বনা সয়েও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশবার চেষ্টা ছিল তাঁর সহজাত। এন্ড্রু কিশোর গানের সুর লয় তাল শিখেছিলেন ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। ওস্তাদের সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়টি ছিল কিশোরের সুরসাধনার সূতিকাগার।
সেই প্রিয়াস্পদ ওস্তাদজি আব্দুল আজিজ বাচ্চু প্রয়াত হলে তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণে গড়ে তুলেছিলেন ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ। এর ব্যানারে রাজশাহীতে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চাও এগিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। এন্ড্রু কিশোর আমৃত্যু ওই সংসদের সভাপতি ছিলেন। তবে প্রাণপ্রদীপ ঠিকানা বদলের আগে জীবনবাদী এই শিল্পী ঠিকঠাকভাবেই স্বীয় বন্ধু ড. দ্বীপকেন্দ্রনাথ দাসের ওপর প্রিয় ওই সংসদের দায়িত্ব অর্পণ করে গেছেন।
ড. দ্বীপকেন্দ্রনাথ দাস রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান। ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়ে এন্ড্রু কিশোরের সহপাঠী। সমবয়সী, রাজশাহী সিটি কলেজে বাণিজ্য বিভাগের সতীর্থ স্টুডেন্ট। সম্পর্ক পৌঁছে যায় নাম ধরে ডাকাডাকি ও তুই-তোকারিতে।
ড. দ্বীপকেন্দ্রনাথ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘আমি যখন শিক্ষকতায় আসি, তখন কিন্তু কিছুদিন পর সে আর আমাকে নাম ধরে ডাকত না। বলত, স্যার কেমন আছ? তখন তুমি হয়ে গেলাম। পরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী রে, তুই আমাদের সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি করে দিলি? সে বলল, না, দূরত্ব নয়। তুমি একজন প্রফেসর মানুষ, তোমার তো সমাজে একটা মূল্যায়ন আছে। আমরা যদি তোমাকে সম্মান না দেই তাহলে অন্যরা কীভাবে সম্মান দেবে?’ এই যে একটা ব্যাপার, এই জিনিসটা আমার এখন খুব মনে পড়ছে।
এই তো আমাদের প্রিয়ভাজন শিল্পী এন্ড্রু কিশোর। অনেকেই বলেন শিল্পী কী এক অজানা অভিমান পুষতেন বুকের ঘরে। আমরা এটাকে বরং দেখি ভিন্নতর আলোকের আয়নায়।
এখনকার যুগের মানুষ হিসেবে এতটা খ্যাতিমান হয়েও এন্ড্রু কিশোর টিভিতে টক শো করতেন না, পত্রিকায় কলাম লিখতেন না। মেইনটেইন করতেন না টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব বা বঙ্গজ সমাজে সবচেয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক। আমাদের কালে এতটা নিভৃতচারিতা সত্যিই ভাবা যায় না।
আমরা তো আজকাল শারীরবৃত্তীয় নিয়মে পশ্চাৎদেশের বায়ুদূষণটারও ছবি তুলে এবং দুলাইন কাব্যের ভণিতা করে পাবলিককে জানান দিই, এই যে দেখো আমি এই করেছি, যা এত সুন্দর তোমরা সবাই তাকিয়ে থাকো আর লাইক-ওয়াউয়ের বন্যা বইয়ে দাও।
এন্ড্রু কিশোরের স্ত্রী লিপিকা একজন প্রকৌশলী। মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা সিডনিতে গ্রাফিক ডিজাইন ও ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক মেলবোর্নে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনা করছেন। তাঁদের নাম আমরা কজন জানি?
অন্য সেলিব্রিটিরা প্রয়াত হলে তাঁর পরিবারের স্বজনদের সরব ও দেখানো আহাজারিতে টিভি ও পত্রিকার চেহারা আর্দ্র হয়ে যায়। সেখানে আমরা কী দেখলাম। এন্ড্রু কিশোরের দুই সন্তানের ফটো খুঁজতে গিয়েই বঙ্গজ মিডিয়া সমাজকে গলদঘর্ম হতে হয়েছে। রূপকথার রংচং নয়, মানবীয় বাস্তবতাবোধই হয়ত শিল্পী পরিবারের পরম আরাধ্য। ধ্যান-ধারণায় এই সময়ের অন্য সবার চেয়ে আলাদা।
এন্ড্রু কিশোর এতটা জনপ্রিয় মানুষ হয়েও তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদেরকে প্রচলিত পথে না হাঁটিয়ে প্রথাবিরোধিতা শেখাতে পেরেছেন। নির্মোহ জীবন গড়তে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
সৈয়দ শামসুল হকের গানটা শুধু গেয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি শিল্পী। তিনি সর্বান্তকরণে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন—হায় রে মানুষ, রঙিন ফানুস দম ফুরাইলেই ঠুস/ তবু তো ভাই কারোরই নাই একটুখানি হুঁশ...
পিতার খ্যাতিতে নিজেদের জাহির করবার প্রবণতার বাইরে রেখে সবার আগে সন্তানদের নিজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ জীবনবোধে উদ্দীপ্ত করতে পেরেছেন। তারপর তুমি যদি বাপের ছায়া থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকতায় জীবনকে গুছিয়ে নিতে পারো তখন মানুষের দুয়ারে গিয়ে মানুষের সন্ধান করো। তারপর মেনে নিও রবীন্দ্রনাথের অমোঘ বাণী—যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে...
কার্যত আমরা এন্ড্রু কিশোরের সন্তানদের মুখচ্ছবি যত্রতত্র দেখি না। মিডিয়ায় তাদের মাতামাতি করতে দেখি না। নিরংহকার এন্ড্রু কিশোরের এটাই নিজস্ব জীবনবোধ। এটাকে যদি শিল্পীর জাত্যাভিমান বা অহংবোধ বলতে চান, বলেন। শিল্প-সমঝদার আমাদের তাতে এতটুকু আপত্তি নেই।
আমরা শুধু আত্মপ্রচারে নিমগ্ন সমাজ ও সংসারের মধ্যিখানে থেকে শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের নিভৃতচারিতা, নিস্তব্ধতা, নীরবতা এবং দাস্যভাব নিয়ে মাটির প্রতি টানকে অনুসরণ করতে চাই। এই সুরসাধকের ব্রতে ব্রতচারী হতে চাই। এবং এটাই হোক এমন মহৎ শিল্পীকে স্মরণের সুবর্ণরেখা। রাবীন্দ্রিক এই নৈবেদ্যের কথা খুব বেশিই জানতেন এন্ড্রু কিশোর। আমরা সেই ‘গীতাঞ্জলি’ আরেকবার স্মরণ করি।
আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥
নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলি করি অপমান,
আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে।
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥
আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে,
তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবনমাঝে।
যাচি হে তোমার চরম শান্তি, পরানে তোমার পরম কান্তি,
আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও হৃদয়পদ্মদলে।
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন