বাংলাদেশের বিপ্লবী বন্ধু শহীদ ডা. মিলন
প্রতিবাদ, বিপ্লব ও দ্রোহ—এই সহোদরেরাই হলো গণতন্ত্রের অতন্দ্র পাহারাদার। ক্ষমতাধরদের স্বেচ্ছাচার যখন সীমা লঙ্ঘনের মাত্রা ছাড়ায়, ওই পাহারাদারেরাই বেয়ারা রাজাকে বাগে আনে। বাংলাদেশ নামক ভূমিরাষ্ট্র তার জন্মের পর আশির দশকে এক ভয়াল স্বেচ্ছাচারের খপ্পরে পড়ে।
কবি শামসুর রাহমান লিখতে বাধ্য হন তাঁর অমর পঙক্তিমালা—‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’।
সকল শুভবোধ ও সদাচারের বিপরীতে পঙ্কিলতার কুৎসিত বালিতে মুখ গুঁজে রাখা অদ্ভুতুড়ে উষ্ট্রকে বাগে আনতে নিজের জীবন বিপন্ন করে বিপ্লবের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে ধরে যাঁরা সমস্বরে বাংলাদেশের জয়বন্দনা করতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর শহীদ ডা. মিলন।
যেন চিহ্নিত ওই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেই বাংলাদেশের ভূমিপুত্র মোহিনী চৌধুরী গানে গানে বলেছেন ‘মানবের তরে মাটির পৃথিবী, দানবের তরে নয়।’
আজ সেই দানবেরা কোন অচিন দেশের বিষাক্ত হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। রয়ে গেছেন মানবতার প্রতীক ডা. মিলন ও তাঁর সতীর্থ নূর হোসেনরা। রয়ে গেছে তাঁদের দিগদিশারি স্লোগান, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।
মোহিনী চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্বকালেই মিলনের মতো বীরদেরই যেন বন্দনা করেছেন—
মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে।
কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা, বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙা
তাঁরা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতে
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে।
আজ সুপ্রভাতে কবির কণ্ঠে আবার এই ভূমিতে বিপ্লবীদের ফেরার আকুতি। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিশ্চয় মানবতাবাদীরা ফিরবেন তাঁদের আপন আলয়ে। মুক্তির গান শোনাবেন পথভোলা পথিককে।
শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের আত্মবলিদানের মধ্য দিয়েই স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন ’৯০-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। আজ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী। শহীদ ডা. মিলন দিবস।
ডা. মিলন ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে ঘাতকের গুলিতে নিহত হন। যে ঘাতকেরা এরশাদ সরকারের তল্পিবাহক ছিলেন মাত্র।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলন নব্বই দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন।
আজ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ডা. মিলনের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছে। আমরাও এই অকুতোভয় বীরকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন ডা. মিলন। তিনি জাসদ ছাত্রলীগ ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএর সঙ্গে যুক্ত হন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে সেই সময় ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর রিকশায় করে শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সভায় যোগ দিতে যাচ্ছিলেন ডা. মিলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে পৌঁছালে তাঁকে গুলি করে এরশাদ সরকারের বশংবদ পেটোয়া বাহিনী। মারা যান সময়ের সাহসী সন্তান মিলন।
পরদিন ২৮ নভেম্বর সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের পক্ষ থেকে সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল আহ্বান করা হয়। রাতে এরশাদ সরকার গণঅভ্যুত্থান ঠেকাতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে জরুরি আইন জারি করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। এতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
ওই ঘোষণার পর পরই হাজার হাজার ছাত্র হল থেকে রাস্তায় নেমে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। জরুরি আইন জারি করার প্রতিবাদে সব সংবাদপত্র প্রকাশনা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মিছিলে মিটিংয়ে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ।
১৫ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা, ৫ দলীয় জোটের নেতারা ও ৭ দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে আন্দোলনের কর্মসূচি বেগবান হতে থাকে।
ডা. মিলনের আত্মত্যাগের রক্তস্রোতে গিয়ে মেশে শোষকের নিষ্পেষণে কোণঠাসা হয়ে থাকা বিস্ফোরিত জনতার অগ্নিগিরি। ভণ্ডুল হয়ে যায় জান্তার সব অন্যায্য ও অন্যায় আদেশ।
ডা. মিলন শহীদ হওয়ার সাত দিনের মাথায় ৪ ডিসেম্বর বিবিসির সান্ধ্য খবরে বাংলার মানুষ স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পিছু হঠবার খবর পায়। নূর হোসেন ও ডা. মিলনদের রক্ত বৃথা যেতে দেয়নি বিপ্লবী বীর জনতা।
ডা. মিলন আজন্মই গণমানুষের মুক্তির স্বপ্ন বয়ে বেড়াচ্ছিলেন। শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন বহুবিধ গণতান্ত্রিক সংগ্রামে।
কাঙ্ক্ষিত সেই গণতন্ত্র সুসংহত হলে, প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পেলে এবং গণমানুষকে রাজনীতি সচেতন করা গেলে মিলনদের স্বপ্ন সার্থক হবে। সচেতনতা, অধিকারবোধ ও প্রতিবাদমুখরতা নিয়ে মানুষ যদি তার আপন মুক্তির কথা সমস্বরে বলতে পারে, তবেই কেবল শহীদ ডা. মিলনদের আদর্শবাদিতার স্বরূপকাঠি আমাদের জাগিয়ে রাখতে পারবে। অন্যথায় মুক্তির মন্দির সোপানতলে আসলে কত প্রাণ বলিদান হবে তার হিসাব কেউ জানে না।
এক নতুন সূর্যের বন্দনায় সব মানবহিতৈষী ও হিতবাদির পক্ষে আজ ডা. মিলন দিবসে এই রাবীন্দ্রিক নৈবেদ্য নিবেদিত হোক।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে’ বলেছেন—
মাঝে মাঝে একদিন আকাশেতে নাই আলো,
পড়িয়া মেঘের ছায়া কালো জল হয় কালো।
আঁধার সলিল ’পরে ঝর ঝর বারি ঝরে
ঝর ঝর ঝর ঝর, দিবানিশি অবিরল—
বরষার দুখ-কথা, বরষার আঁখিজল।
ওরে, চারিদিকে মোর
এ কী কারাগার ঘোর!
ভাঙ ভাঙ ভাঙ কারা, আঘাতে আঘাত কর!
ওরে,আজ কী গান গেয়েছে পাখি,
এয়েছে রবির কর!
লেখক : সাংবাদিক