নোবেল শান্তি পুরস্কার
মুক্তমত ও সাংবাদিকতার জয়
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতা এখন ভয়াল চাপের মুখে। স্বাধীন কণ্ঠ রোধ করতে বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের নির্যাতনের পাশাপাশি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।
সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মীদের অধিকার-সংক্রান্ত গ্রুপগুলো, বিশেষ করে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক ফেডারেশন আইএফজের পরিসংখ্যান মতে, গেল তিন দশকে বিশ্বব্যাপী আড়াই হাজারেরও অধিক সাংবাদিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারা গেছেন। রোজই নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন কোনও না কোনও সাংবাদিক।
এমন দমবন্ধ পরিস্থিতিতে এবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন দুই প্রথিতযশা সাংবাদিক, যাঁরা কিনা শাসকের ভয়াল হুলিয়া মাথায় নিয়ে ভয়ডরহীনভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন। ক্ষমতাসীনদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অসাধুতার খবর প্রকাশে অবিচল রয়েছেন।
১৯৩৫ সালের পর এই প্রথম শান্তিতে নোবেল পেলেন কোনও সাংবাদিক। ১৯৩৫ সালে জার্মান সাংবাদিক কার্ল ফন অসিয়েতস্কি শান্তিতে নোবেল পান।
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি গেল শুক্রবার এ বছরের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য যে দুজন সাংবাদিকের নাম ঘোষণা করেছে, তাঁদের একজন ৫৯ বছর বয়সী দিমিত্রি আন্দ্রেয়েভিচ মুরাতভ, যিনি রাশিয়ান নোভায়া গেজেটার সাহসী সম্পাদক।
দিমিত্রি মুরাতভের নোভায়া গেজেটা সপ্তাহে তিন বার প্রকাশ হয়। পত্রিকাটিতে নিয়মিতভাবে ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি ও অন্যান্য অনিয়মের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার ব্যক্তিদের দুর্দশার চিত্রও তুলে ধরা হয় অনুপুঙ্খভাবে।
অপর জন হলেন ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা। মারিয়া রেসা নিউজসাইট র্যাপলারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ‘ক্ষমতার অপব্যবহার, সহিংসতা ও ফিলিপাইনে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে’ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করে আসছেন।
গণতন্ত্র ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পূর্বশর্ত হিসেবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় যাঁরা নিরলস কাজ করছেন, সেসব সৎ ও সাহসী সাংবাদিককে সম্মানিত করায় নোবেল ইনস্টিটিউটকে সাধুবাদ জানাই। আর হার্দিক অভিবাদন জানাই নোবেল লরিয়েট দুই সাংবাদিককে।
নরওয়েজিয়ান নোবেল ইনস্টিটিউট বলেছে, বিশ্বে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সব সাংবাদিকের প্রতিনিধি হিসেবে এই দুজনকে পুরস্কারে ভূষিত করা হলো।
নোবেল পিস প্রাইজ কমিটির চেয়ারপারসন রেইস-অ্যান্ডারসন বলেন, ‘মুক্ত, স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা হলো ক্ষমতার অপব্যবহার, মিথ্যা আর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের সময়ে জাতিতে জাতিতে ভ্রাতৃত্ব এগিয়ে নেওয়া, নিরস্ত্রীকরণ এবং একটি উন্নত বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন হবে।’
একের পর এক সহকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার এবং নানা হুমকি পাওয়ার পরেও মুরাতভ প্রধান সম্পাদক হিসেবে তাঁর পত্রিকার স্বাধীন সাংবাদিকতার নীতি পরিহার করেননি। সাংবাদিকতার নৈতিক ও পেশাগত মানদণ্ড বজায় রেখে সাংবাদিকেরা যা লিখতে চেয়েছেন, তা লেখার অধিকার রক্ষায় তিনি ধারাবাহিকভাবে কাজ করে গেছেন।
দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ায় কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে। একনায়কোচিত নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র বলে যে শাসন চলছে, তার বিপক্ষ শক্তিরা সেখানে প্রায় অচল। শাসকের রক্তচক্ষুকে ডরায় না, এমন ব্যক্তি ও সংস্থা সেখানে মেলা ভার। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার যেমনটা বলেছেন, ‘It is dangerous to be right in matters on which the established authorities are wrong.’
এমন বাস্তবতায় রাশিয়ার শাসকগোষ্ঠী, বিশেষত প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সমালোচক হিসেবে পরিচিত যে কয়েকটি পত্রিকা দেশটিতে অবশিষ্ট রয়েছে, নোভায়া গেজেটা সেগুলোর একটি।
নোভায়া গেজেটার বিপ্লবী সম্পাদক ও আপসহীন সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ তাই এবার পেলেন বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মাননা।
রেসার ব্যাপারে পিস প্রাইজ কমিটির তরফে বলা হয়েছে, ফিলিপাইনের অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘র্যাপলার’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা রেসা তাঁর মাতৃভূমি ফিলিপাইনে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার, সংঘাতের ব্যবহার এবং ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদের উন্মোচনে’ মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ব্যবহার করে প্রশংসনীয় স্থান লাভ করেছেন। ফিলিপাইনের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের একজন। যাঁর বিরুদ্ধেও আছে ব্যাপক দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ। তাঁর শাসনব্যবস্থায় স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রায় সংকুচিত করে রাখা হয়েছে। সেখানে একজন নারী হয়ে মারিয়া রেসাকে সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে বড় দুঃসাহসের পরিচয় দিতে হচ্ছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার খবর জানার পর মারিয়া রেসা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি বাকরুদ্ধ।’ আর দিমিত্রি মুরাতভ বলেন, ‘আমি (আনন্দে) হাসছি শুধু। আমি আসলে এতটা আশা করিনি।’
সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভকে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কিংবা মারিয়া রেসাকে রদ্রিগো দুতার্তে অভিনন্দিত করতে পারবেন কি না, আমরা জানি না। তবে মানবীয় সরবতার মাধ্যমে বৈশ্বিক মানবাধিকার রক্ষায় এবং মুক্তমত ও বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় এবারের শান্তি পুরস্কার নিঃসন্দেহে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
রাশিয়া কিংবা ফিলিপাইনের ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্যে কয়েক দশক ধরে বাকস্বাধীনতা রক্ষায় কাজ করছেন এই দুই সাংবাদিক। বিশ্বজুড়ে এমন মহৎ দায়িত্ব পালন করছেন হাজারও সাংবাদিক।
মানবাধিকার রক্ষা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে সেসব সাংবাদিকের ভূমিকা অবশ্যই অগ্রগণ্য। যাঁরা সেই অগ্রদূতদের যথোচিত মূল্য দিতে শিখবেন, বৈশ্বিক সভ্যতার মানদণ্ডে তাঁরা স্বমহিমায় টিকে থাকবেন। কঠোর সমালোচনার ঝড় থেকে বাকিদের মুক্তি নেই। গণমাধ্যমের ওপর থেকে খড়গ অপসৃত না হলে মানুষের ভালো থাকবার মহিমাগুলো অপপ্রচারেই পর্যবসিত হবে। মিডিয়াগুলো ‘ল্যাপডগ’ না হয়ে ‘ভ্যানগার্ড’ হিসেবে বহাল থাক।
দার্শনিক ভলতেয়ারের নামে প্রচলিত এই উক্তি দেশে দেশে চির প্রাসঙ্গিক থাকুক, ‘I wholly disapprove of what you say—and will defend to the death your right to say it.’
লেখক : সাংবাদিক