রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা গণমাধ্যমের লজ্জাজনক বর্ণবাদ

Looks like you've blocked notifications!

স্বাতী চতুর্বেদি একজন আন্তর্জাতিক পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক এবং ‘আই অ্যাম আ ট্রল : ইনসাইড দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব দ্য বিজেপি’স ডিজিটাল আর্মি’ বইয়ের লেখক। তিনি বলছেন—বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেই বাজে ও বর্ণবাদী বিষয়াদি প্রচার করছে কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। তাঁর এ লেখাটি সম্প্রতি গালফ নিউজে বিশেষজ্ঞ মতামত হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। লেখাটি অনুবাদ করেছে এনটিভি অনলাইন।  

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধের খবরাখবর জানানো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীদের খোলামেলা বর্ণবাদী মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া দেখে রীতিমতো ধাক্কা খেতে হয়। ইউরোপে সীমান্তরক্ষীরা যেভাবে শরণার্থীদের আটকে দিচ্ছেন এবং সরাসরি বর্ণবিদ্বেষী আচরণ করছেন, তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক শুদ্ধতার আবরণে ঠিক কীভাবে ছড়িয়েছে বর্ণবাদ।

আরব, ভারতীয়সহ অশেতাঙ্গদের (সীমান্তে) আটকে দিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়—তাঁরা সীমান্ত পেরোতে পারবেন না। আমরা যারা দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করি এবং সাংবাদিক হিসেবে কাজ করি, কুৎসিত বর্ণবাদের অস্তিত্ব আমাদের বরাবরই জানা। কিন্তু, ইউক্রেন সীমান্তে বর্ণবাদের বিষময় চিত্র আমাদের হতবাক করেছে।

প্রিয় পাঠক যদি মনে করে থাকেন—বৈশ্বিক এক সংকটের মধ্যে অকারণে এসব টেনে আনা হচ্ছে, তাহলে চলুন কয়েকটি গণমাধ্যমের খবর আপনাদের জানানো যাক।

বিবিসি স্টুডিওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইউক্রেনের ডেপুটি চিফ প্রসিকিউটর ডেভিড সাকভারেলিডজে বলেছেন, ‘আমি খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি। কারণ, আমি দেখতে পাচ্ছি—নীল চোখ আর সোনালি চুলের ইউরোপীয় লোকজনকে হত্যা করা হচ্ছে।’ এমন সরাসরি বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য শুনে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক কোনো মন্তব্য না করলেও সহানুভূতি দেখিয়ে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ান।  

বর্ণবাদী পথে বিবিসি

বিবিসির অর্থায়ন হয় যুক্তরাজ্যে বসবাসকারীদের দেওয়া কর থেকে। আর, যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণকারীদের মধ্যে বাদামি, কৃষ্ণাঙ্গ এবং অন্যান্য বর্ণের মানুষের অভাব নেই। যুক্তরাজ্যের সম্প্রচারমাধ্যম বিবিসিকে প্রজ্ঞা ও সাম্যের প্রচারক হিসেবে দেখা হয়। সেই বিবিসি যখন বর্ণবাদী পথে হাঁটে, তখন তাকে হতাশাজনক বললেও কম বলা হয়।

সিবিএসের খ্যাতিমান সংবাদদাতা চার্লি ডি আগাতা বলেছেন, ‘ইরাক বা আফগানিস্তান নয়, (ইউক্রেন) একটি সভ্য ইউরোপীয় শহর।’ বিবিসির মতো সিবিএসও চার্লির এমন ঢালাও বর্ণবাদী মন্তব্যের সমালোচনা করার প্রয়োজনবোধ করেনি।

এবার আলজাজিরার এক সাংবাদিক কী বলছেন, শোনা যাক—‘তাদের পোশাকের দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। (বোঝাই যায়) তারা স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত। তারা তো আর মধ্যপ্রাচ্য বা উত্তর আফ্রিকা থেকে পালানোর চেষ্টারত শরণার্থী নয়। তারা দেখতে আপনার পাশের বাসার যেকোনো ইউরোপীয় পরিবারের মতো।’

বিএম টেলিভিশন ফ্রান্স আরও বাজেভাবে বলছে—‘আমরা একুশ শতকের একটি ইউরোপীয় শহরে রয়েছি। এবং এমন ক্ষেপণাস্ত্র-হামলা দেখছি, যেন আমরা আফগানিস্তান বা ইরাকে রয়েছি। আপনি ভাবতে পারেন!’

হ্যা, পারি বইকি! আফগানিস্তান আর ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছিল পশ্চিমা দেশগুলোই। ভুয়া রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের অজুহাতে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বে নির্বিচারে হামলা চালানো হয়েছে।

তবে, (ইউক্রেন-রাশিয়া) ইস্যুতে পশ্চিমা ইউরোপীয় গণমাধ্যম ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করবে—তা কিন্তু ভাবাও যায় না।

ইনস্টাগ্রাম ও নেটফ্লিক্সে অ্যাকাউন্ট থাকা                                 

এ প্রতিবেদনটি যে স্বস্তিদায়ক কোনো খবর নয়, তা পাঠক এতক্ষণে বুঝে ফেলেছেন।

দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফে কী বলা হয়েছে, সেটি এবার জানা যাক। ড্যানিয়েল হান্নান সেখানে লিখেছেন, ‘এবারের যুদ্ধটি ন্যায়সঙ্গত নয়। কারণ, (যুদ্ধে জড়িতেরা) দেখতে আমাদেরই মতো। আর, এসব লোকজনের ইনস্টাগ্রাম ও নেটফ্লিক্সের অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এবারের যুদ্ধ কোনো গরিব-দুর্গম দেশে হচ্ছে না।’

দুটি বিষয় : (এক.) যুদ্ধ কখনোই সঠিক পথ হতে পারে না। এবং (দুই.) এমন কিছু কীভাবে বলা সম্ভব! হান্নান কি তাহলে বিদ্রুপ করার চেষ্টা করলেন? যদি তা হয়ও, বলতে হবে—চরম ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।

সর্বশেষ উদাহরণটি যুক্তরাজ্যের আইটিভির। সেখানে বলা হয়েছে, ‘অভাবনীয় কাণ্ড ঘটল। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল কোনো দেশে নয়, ইউরোপে।’

হ্যাঁ, ঘটনা ইউরোপেরই। আর, এখানকার বর্ণবৈষম্যের প্রকাশটিও হয়েছে বেশ জোরেশোরে এবং গর্বিত সুরে। আমি বেশ কয়েক বছর লন্ডনে থেকেছি এবং কাজ করেছি। তবে, সে সময়কার বর্ণবাদ এতটা প্রকাশ্য ও বিকট না হলেও, ইউরোপে বর্ণবাদের সূক্ষ্ণ অস্তিত্ব বরাবরই ছিল।

অথচ, নতুন এক বিশ্বের বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে আমরা সবাই এবং সব দেশ সমান গুরুত্ব আর সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে—এমনটাই হওয়ার কথা ছিল না কি?

কিন্তু, না। তেমনটি যে হয়নি, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। ইউক্রেন থেকে বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যম যেন বলছে—আপনি যদি সোনালি চুল কিংবা নীল চোখের নারী-পুরুষ না হন, তাহলে আপনার দেশে আক্রমণ করা যাবে। এবং অ-ইউরোপীয়রা শরণার্থী হতে পারে। শেতাঙ্গরা বিশ্বকে সভ্য করার বোঝা কাঁধে নিয়েছে, কিন্তু শেতাঙ্গ ইউরোপীয় বর্ণবাদকে সঙ্গে নিতে পারেনি।

শয়তানের মতো রোজকার এমন বর্ণবাদও সদা পরিত্যাজ্য। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো কীভাবে এমন জঘন্য বর্ণবাদী খবর বা অনুষ্ঠান প্রচারে সায় দিতে পারে! আর, স্টুডিওতে কেউ যখন বর্ণবাদী মন্তব্য করেন, তখন সংশ্লিষ্টরা কিংবা সঞ্চালক কেন ওই ব্যক্তির সমালোচনা করেন না?

বেশির ভাগ দেশের সম্প্রচার আইনে উসকানিমূলক বিষয়বস্তু সম্প্রচারে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞার উল্লেখ রয়েছে। ভারতে তথাকথিত মূলধারার গণমাধ্যমে সংখ্যালঘুদের নিয়ে এমন কিছু বিষয় দেখানো হয়, যা দেখে লজ্জিত হই। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ইউক্রেন-রাশিয়া ইস্যুতে যা করছে, তাতে ঠিক তেমনই লজ্জা লাগছে।