সেলিম আল দীন ও জল শিকড়ের গান
বাঙালি সহস্র বছরের নন্দনতত্ত্বের আলোকে পাশ্চাত্য শিল্পের সকল বিভাজনকে অস্বীকার করেছেন শেকড়সন্ধানী শিল্পতাত্ত্বিক নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। বিশেষকরে ঔপনিবেশিক নাট্যরীতি ও নাট্যভাষাকে সপ্রাণ ও সজ্ঞানে প্রত্যাখ্যান করে দেশাত্মবোধকে জাগরুক করে গেছেন তিনি। অত্যুঙ্গ সাধনায় বাঙালির লোককৃত্যকে অনন্য মহিমায় অভিষিক্ত করেছেন।
এই পথ বেয়েই বাংলা সাহিত্যে নবরীতির শিল্প প্রবক্তা হয়ে ওঠেছেন তিনি। দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পরীতি যার নাম। সেলিম আল দীন তাঁর সৃষ্টিশীলতার আলোকঝর্ণা দিয়ে জীবনের প্রাঙ্গনে সুন্দরের অর্থ খুঁজে ফিরেছেন।
সেলিম আল দীন নিজেই বলেছেন, বস্তুতপক্ষে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের আবিষ্কারের পরে বা ওই শিল্পতত্ত্বের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস জন্মানোর ফলে আমি চলতি অর্থে নাটক লিখি না। আমার লেখাগুলো ঐতিহ্যবাহী বাংলা পাঁচালি ও কথকতার ধারায় সমকালীন প্রয়াস।’
সেলিম আল দীন সাহিত্যে পাশ্চাত্য ঘরাণার বর্গ-বিভাজন বা শাখা-বিন্যাস নেই। একটি রচনার মধ্যেই কবিতা, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতি আঙ্গিকের উপস্থিতি তাঁর উদ্ভাবিত দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের মূল কথা।
শিল্প সাধনার অপার অনুসন্ধিৎসায় অরূপের সন্ধান করেছেন তিনি। লিখেছেন অসংখ্য কালজয়ী নাটক। কবিতা ও গান রচনাতেও সমান সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি।
নাটক ছাড়াও স্বল্পসংখ্যক গান রচনার মাধ্যমে মানবীয় জীবনবোধ, প্রকৃতির বিস্ময় ও অতুল্য বিশ্ববীক্ষা উপস্থাপন করেছেন সেলিম আল দীন।
যশস্বী ফোকলোর গবেষক সায়মন জাকারিয়ার সংকলন ও গ্রন্থনায় প্রণীত সেলিম দীন রচনাসমগ্রে গানগুলো সন্নিবেশিত আছে।
সেলিম আল দীন তাঁর নাটকের সংলাপগুলোকেও এক অমোঘ গীতিময়তার ছাঁচে বেধে গেছেন। বেশিরভাগ সংলাপই সুরের আবহে উপস্থাপন করা যায়। ইতোমধ্যে অনেক নাট্যনির্দেশক সেটি করেও দেখিয়েছেন। নিজের কন্ঠ, সুর, মেধা ও মনন দিয়ে সেলিম আল দীনের নাটকের গানকে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন মঞ্চকুসুম শিমুল ইউসুফ।
'বাংলা গানের উপান্তে' প্রবন্ধে সেলিম আল দীন লিখেছেন, 'বাংলা গানের সহস্র বছরের সাধনা-আমাদের অমনোযোগ-অসতর্কতা এবং সর্বোপুরি অক্ষমতার শিকার হয়েছে এর মূল্য অন্যভাবে-আরও বৃহৎ আকারে সংস্কৃতির সর্বগ্রাসী মূল্যে হয়তো পরিশোধ করতে হবে। কারণ রুচির সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্যের যাদুকরী প্রভাব বিস্তারের শক্তি অন্য সকল শিল্পমাধ্যমের চেয়ে গানেরই বেশি। ধর্ম সাধনার একটা বিস্তারিত অংশ আদিকালে সুরেই বাধা হয়েছিল। কোনো দেশ বা জাতির সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ক্ষয় ও অধঃপতন সে জাতির মানস-ক্ষেত্রের সামগ্রিক অধঃপতনের সূচনা বিন্দুকেই নির্দেশ করে। সঙ্গীত-ভূগোলের অংশ-সংস্কৃতির রক্তনালিকা সকল শিল্পমাধ্যমের জননীও বটে।'
সেলিম আল দীন বলেছেন, 'বাঙলা গানকে দাঁড়াতে হবে পূর্বের অহঙ্কারে-শব্দ ও সুরের গভীর মনষ্কতায়। এর কোনো বিকল্প অন্তত আমার জানা নেই।'
সেলিম আল রচিত বেশকিছু গান দেশের প্রথিতযশা শিল্পী ফাহমিদা নবী দরদ দিয়ে গেয়ে 'আকাশ ও সমুদ্র অপার' শিরোনামে অ্যালবামবন্দি করেছেন। ফাহমিদা নবীর মায়াবী দরাজ কন্ঠ সেলিম আল দীন পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কথায় গানের অ্যালবামটি আয়ুরেখার অকাল খামখেয়ালিতে স্বচক্ষে দেখে যেতে পারেননি। আমরা সেলিমশিষ্যরা মনে এই প্রতীতি রাখি, নিশ্চয় তিনি তাঁর গানগুলো শুনছেন।
আর গুণগুণিয়ে গাইছেন,
আকাশ ও সমুদ্র অপার
তারো অধিক জীবনে জীবন এই শূন্যতা
শেষ নেই তার শেষ নেই
কত জন্ম কত মৃত্যু
পারায়ে পারায়ে যায় তার
শেষ নেই শেষ নেই।।
সেলিম আল দীনের ছাত্র রুবাইয়াৎ আহমেদ তাঁর লেখা একটি স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, 'সেলিম স্যার ‘কহন কথা’ নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গানের একটি দল গঠন করেছিলেন। দলটি নিয়মিত কোনো অনুষ্ঠানে অংশ না নিলেও স্যারের লেখা ও সুরে অনিয়মিত গানের চর্চা চালাতো। তবে প্রতিবছর ‘মহুয়া ফুল ফোটার উৎসব’ এ দলটির গান পরিবেশন ছিল বাধ্যতামূলক।'
মহুয়া উৎসবের সেই ধারাবাহিকতা এখনো ধরে রেখেছে সেলিম আল দীনের আদিঘর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ।
সেলিম আল দীন তাঁর একটি গানে লিখেছেন,
ফেলে এলাম ফেলে এলাম
সাদা মেঘে জল কল্লোল শঙ্খ বাতাস
ফেলে এলাম সূর্যকিরণ
বিচ্ছুরণের স্বর্ণকুহক।
ফেলে এলাম নদীর জল
রৌপ্য শীর্ষ বাঁশের দোলা
তোমার মুখ বিচিত্র রং
ছায়াসন্ধি সন্ধ্যাতারা।
কথা-জীবনের নানা রঙের দিনগুলি পেরিয়ে এসে এক অনিশ্চিত অনন্তের সামনে দাঁড়িয়ে এ আমার অনিবার্য উচ্চারণ।
গানের শেষে এমন একটি কথাও সংযোজন করেছেন গীতিকার সেলিম আল দীন। এ যেন আমাদের সবারই অনিবার্য উচ্চারণ। মানুষকে নস্টালজিক করে দেয়ার এমন আরেকটি উদাহরণ কেবল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়ানে পাওয়া সম্ভব।
পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
সেলিম আল দীন গান বলতে রবীন্দ্রনাথ বুঝতেন।
গলায় সুর হয়ত স্বরসতী হয়ে ধরা দিত না। কিন্তু গীতবিতানের শত শত গান তিনি মুখস্থ বলতে পারতেন। আমাদের ছাত্রদের সকাশে ক্লাসে প্রায়ই বলতেন, আজ সকালে রবীন্দ্রনাথ শুনে বাসা থেকে বের হয়েছি, অন্য কিছুই আর ভালো লাগবে না। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারা শিক্ষার্থীদের বাড়তি স্নেহের চোখে দেখতেন। রবীন্দ্রমোহাবিষ্ট বলতে যা বুঝায়, এক কথায় সেলিম আল দীন তাই ছিলেন।
সেলিম আল দীন তাঁর অপর একটি গানে লিখেছেন,
মৃত্যুর কোনো অমোঘ ঠিকানায়
ওরা চলে যায়
ঐ পাখিটা শিষ দিচ্ছে গান গাইছে
উড়াল দিচ্ছে আকাশে
তারপর নামল সন্ধ্যা
সূর্য ডোবার কোন সে ঠিকানায়
ওরা চলে যায়।
গহন গহীন মরণারণ্যে ওরা চলে যায়
মরণ আঁধার খোঁড়ার ক্ষণে ওরা চলে যায়
মৃত্যুর কোন অচীন ঠিকানায়।
আজ ১৪ জানুয়ারি ১৫তম প্রয়াণবার্ষিকীতে। চলে যাওয়ার এই গানটিই খুব বেশি মনে পড়ছে।
জীবন এক রঙ্গমঞ্চ, সেই মঞ্চের প্রধানতম নটবর যেন আমাদের শিক্ষা ও দীক্ষাগুরু সেলিম আল দীন। জীবনদেবতা আর কিছু সময় বরাদ্দ রাখলে সেলিম আল দীন নিশ্চয়ই অজর গানের সোনারতরীকে তাঁর কাঙ্খিত সুবর্ণবন্দরে ভেড়াতেন।
সেলিম স্যার আপনি যেন এক উন্মনা বাউল হয়ে দক্ষিণহস্তে একতারা বাজাতে বাজাতে জাহাঙ্গীরনগরের অরণ্যপথের বাঁকে বাঁকে গেয়ে চলেছেন,
তোমার মন ভালো নেই
ফুলেদের মন ভালো নেই
মেঘেদের মন ভালো নেই...
প্রিয় সুরসাধক আপনার অবিনাশী আত্মা প্রীত হোক।
আপনার প্রিয়তম সুরগুলি এই শিষ্যদের সঙ্গী হোক।
আপনি সেই উনিশশো সাতাত্তরে বলেছিলেন,
বিশ্বজয়ী কাব্য প্রয়াসের পাশাপাশি বাংলাগানের সমান্তরাল ভাবলোক সৃজন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। কাব্যের মানস উৎপল তেমন গান চাইতে গিয়ে পেশাদারী গায়কের চিরাচরিত রীতি ও বাণিজ্যিক গানের বিরুদ্ধে তরুণদের রুখে দাঁড়ানোর দাবিও তুলেছিলেন। আপনার সেই সংকল্পের নাম ছিল জল শিকড়ের গান।
আজ এই প্রয়াণবার্ষিকীতে আপনার এই ভাবশিষ্য আশাবরী রাগে দাদরা তালে এই ভূমির মহিমান্বিত শিল্পমানুষ আপনাকে স্মরণ করে।
সে আদিম মুখ দেখিব তোমার
কুমারের লাল সরাতে
খুঁড়তে খুঁড়তে মিলবে মুখোশ
খনিত মাটির গভীরে।
লেখক: সাংবাদিক ও সেলিম আল দীনের ছাত্র