স্বপ্নময় স্মৃতিগুলো স্মরণ করে মুহিত ভাইকে বিদায় জানাচ্ছি : ড. ইউনূস

Looks like you've blocked notifications!
ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি

সদ্যপ্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবুল মাল আবদুল মুহিতকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। স্বাধীনতা ঘোষণার সময় থেকে শুরু করে আবদুল মুহিতের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা স্থান পেয়েছে তাঁর স্মৃতিচারণে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আজ রোববার দুপুরে এক পোস্টে এ স্মৃতিচারণ করেন ড. ইউনূস।

সে স্মৃতিচারণের শেষ পর্যায়ে গিয়ে ড. ইউনূস লেখেন, ‘তাঁর (আবদুল মুহিত) সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের বহু আনন্দময়, স্বপ্নময়, গৌরবময় স্মৃতিগুলো স্মরণ করে মুহিত ভাইকে আজ বিদায় জানাচ্ছি। আল্লাহ তাঁর রূহের মাগফেরাত দান করুন।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে সেই স্মৃতিচারণটি হুবহু তুলে দেওয়া হলো :

‘মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ওয়াশিংটন ডিসিতে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, এটা রেডিওতে শুনে আমরা ন্যাশভিলের ছয় জন বাঙালি তাৎক্ষণিকভাবে একত্র হয়ে বাংলাদেশ সিটিজেনস কমিটি গঠন করলাম। প্রত্যেকে এক হাজার ডলার জমা করে একটা তহবিল বানালাম। আমি ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় উচ্চতম ব্যক্তি এনায়েত করিমকে ফোন করলাম। বললাম, আমি ওয়াশিংটন রওনা হচ্ছি। সবার সঙ্গে আলাপ করে কর্মসূচি তৈরি করতে হবে। তিনি আমাকে উৎসাহ দিলেন চলে আসার জন্য। ছয় হাজার ডলারের তহবিল সঙ্গে নিয়ে পরদিন ওয়াশিংটনে গিয়ে সোজা উঠলাম এনায়েত করিমের বাসায়, যার সঙ্গে কোনোদিন আমার পরিচয় ছিল না।’

‘এরপর ওয়াশিংটনে প্রায় রাতে মুহিত ভাইয়ের বাসায় সবাইকে নিয়ে বসা আমাদের নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়াল। নানা সংবাদ আদান-প্রদান করা, নানা উত্তেজনাপূর্ণ বিতর্ক, হাতাহাতি—সবকিছুই এ বৈঠকের অংশ হয়ে দাঁড়াল। যারা ওয়াশিংটনের লোক, তারা সারাদিন তাদের অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমরা কজন যারা অন্য শহর থেকে এসেছি, তারা সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে কাজ করতে থাকলাম। একদিন মুহিত ভাই বললেন, একটা ওয়্যারলেস সেটের জন্য কিছু টাকার দরকার। আমি ন্যাশভিলের ছয় হাজার ডলার তাঁর হাতে দিয়ে দিলাম।

‘আমরা কজন আরেকটা দায়িত্ব নিলাম। এটা হলো বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোতে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানাবার জন্য অনুরোধ জানানো। মুহিত ভাই আমাদের সঙ্গে দূতাবাসগুলোর পরিচয় করিয়ে দিতেন এবং আমাদের ব্রিফ দিতেন, কার কাছে কীভাবে আমাদের প্রস্তাবটি উত্থাপন করতে হবে।

‘দেশে ফিরে আসার পর আবার মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হলো তাঁরই উদ্যোগে। তিনি আমার কর্মসূচি সম্বন্ধে জানতে চান। তিনি সরকারি চাকরিতে বিরক্ত হয়ে গেছেন। বললেন, তিনি আমার কর্মকাণ্ড চাক্ষুষ দেখতে চান। আমি সানন্দে ব্যবস্থা করলাম। তাঁকে নিয়ে পুরো একটা দিন টাঙ্গাইলের হাঁটুভাঙ্গা শাখায় কাটালাম। তাঁর হাজারও প্রশ্নের জবাব দিলাম। ঢাকা ফেরার পথে অনেক কথা বললেন। তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন। আমার সঙ্গে গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করবেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা স্থাপন করবেন সিলেটে।

‘পরবর্তী সময়ে শুনলাম, তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তারপর বোধহয় বিদেশ চলে গেছেন। আবার দেখা হলো ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে, কুমিল্লা একাডেমিতে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। আমরা দুজনেই সম্মেলনের বক্তা। আগের দিন সন্ধ্যায় অনেক আলাপ হলো। বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ নিয়ে আমি একটা কনসেপ্ট পেপার লিখেছিলাম। সেটা তাঁকে দিলাম এবং মুখে সবিস্তারে বোঝালাম।

‘সম্মেলনের পরের দিন সকাল বেলায় আমাদের সবার ঢাকায় ফেরার কথা। কিন্তু, হঠাৎ সারা দেশে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেছেন।

‘আমরা কুমিল্লায় আটকে গেলাম। দুজনে আরও বহু কথা বলার সুযোগ পেলাম। কারফিউ প্রত্যাহারের পর সন্ধ্যায় ঢাকা ফিরলাম। পরদিন ঘোষণা শুনলাম মুহিত ভাই নতুন সরকারে অর্থমন্ত্রী হিসেবে যোগ দিয়েছেন। আমি অভিনন্দন জানালাম। তিনি দেখা করার জন্য খবর পাঠালেন। মনে মনে খুশি হলাম এই ভেবে যে, এবার গ্রামীণ ব্যাংককে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সুযোগ পাব।

‘দেখা করলাম। তারপর ঘটনা এগোতে থাকল। এক পর্যায়ে এসে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ জারি হলো। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলো—নতুন ব্যাংকের উদ্‌বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে। আমরা অনুষ্ঠানের জন্য এক পায়ে খাড়া। কিন্তু মন্ত্রণালয় চায়, এটা ঢাকায় করতে। আমরা বেঁকে বসলাম। আমরা বললাম গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান গ্রামে হবে। মন্ত্রণালয় কিছুতেই এতে রাজি হবে না। আমি মুহিত ভাইকে ফোন করলাম। তিনি সোৎসাহে বললেন—অবশ্যই এটা গ্রামে হবে এবং আমি সেখানে যাব।

‘১৯৮৩ সালের ৩ অক্টোবর টাঙ্গালের জামুর্কী গ্রামে ভূমিহীন মহিলাদের এক বিরাট সমাবেশের মাধ্যমে মুহিত ভাইয়ের উপস্থিতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্‌বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হলো।

তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের বহু আনন্দময়, স্বপ্নময়, গৌরবময় স্মৃতিগুলো স্মরণ করে মুহিত ভাইকে আজ বিদায় জানাচ্ছি। আল্লাহ তাঁর রূহের মাগফেরাত দান করুন।’