ফুটবল
বিপিএল থেকে বিপিএল

তিনি বিতর্কিত। নিষিদ্ধ। দেশান্তরিত। তবে তাঁর মস্তিষ্কজাত একটা পণ্যের বাজার রমরমা। এবং এতটাই যে সেটা নকল করে অন্য বাজারে যা এসেছে, তা-ও মারমার-কাটকাট!
হ্যাঁ, ললিত মোদির মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়েছিল ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ—আইপিএল। পণ্য হিসেবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট কত মূল্যবান হতে পারে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে আছে আইপিএল। আইপিএলের আকর্ষণ এতই তীব্র তা শুধু মাঠের গ্যালারিতে দর্শক টেনে আনে না। খেলার সময় টেলিভিশনে ৩০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকা গুনতেও দ্বিতীয়বার ভাবে না। আবার আইপিএলে খেলার জন্য অনেক তারকা ক্রিকেটার তাঁদের টেস্ট ক্যারিয়ারকেও ভেবেচিন্তে বিদায় জানিয়েছেন! জানাচ্ছেন। সব মিলিয়ে ললিত মোদির এই ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেট শুধু ক্রিকেট গ্রহে নয়, ক্রীড়াবিশ্বেই দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। অনেকে রসিকতা করে বললেও বাস্তবতা হচ্ছে, বিকোনোর জন্য ‘ললিত-কলা’ এখন দুর্দান্ত এক পণ্য।
আইপিএল ক্রিকেট বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। এরপর সেই আইপিএলের জেরক্স কপির মতো ক্রিকেট বাজারে এলো বিপিএল, সিপিএলসহ কত পিএল! বিষয়টা খারাপ কিছু নয়। ক্রিকেটাররা বিভিন্ন দেশে খেলার সুযোগ পাচ্ছেন। ডলার পাচ্ছেন। বড় বড় ক্রিকেটারের সঙ্গে স্থানীয় অনেক উঠতি ক্রিকেটার ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করার সুযোগ পাচ্ছেন। তরুণদের অভিজ্ঞতা বাড়ছে। দর্শক অল্প সময়ে বিপুল আনন্দ পাচ্ছেন। ক্রিকেটের মাধ্যমে অন্য পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া যাচ্ছে। বাজার বাড়ছে। কৃতজ্ঞচিত্তে তাই বলা উচিত—‘জয় ললিত’!
কিন্তু বলা যাচ্ছে না। কারণ, ললিত মোদি পথ দেখিয়েছেন, অন্যরা সে পথে হাঁটছেন। এটা যেমন সত্যি, আবার একই সঙ্গে সত্যি না। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, আইপিএল নামটা ললিত মোদি অনুকরণ করেছিলেন ইপিএল থেকে, মানে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। আর সেটা ফুটবল লিগ। ললিত মোদি সেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অনুকরণে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ ছেড়ে দিলেন ক্রিকেট বাজারে। তারপর বাকিরা নিজেদের মতো করে বিভিন্ন দেশে প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ চালু করলেন। বাজার পেলেন। আইপিএলের পরের বাজার তো এখন বিপিএলের, মানে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের। বাংলাদেশ ক্রিকেট আর ক্রিকেটানুরাগীদের জন্য সেটা ভালো খবর।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্রীড়াবাজারে বিপিএল নামে আরেকটা পণ্য পড়ে রইল ডেট এক্সপায়ার্ড করে যাওয়া জিনিসের মতো। কেউ কিনতে চান না! শুধু নেড়েচেড়ে দেখেন। সেটাও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ। তবে ক্রিকেট নয়, ফুটবল। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল। এই পণ্যটা বাজার না পাওয়ার কারণ কি শুধুই এ দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়া? মোটেও না। ফুটবল নামক খেলাটাকে বাংলাদেশে যাঁরা অভিভাবকত্ব করছেন, তাঁদের মধ্যে একজন ললিত মোদিও নেই, যিনি বিলেত থেকে একটা নাম নকল করে এনে দিতে পারবেন! পেশাদার লিগ, জাতীয় লিগ অনেক নামে লিগটা চালানোর পর বাফুফের কর্তারা বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটের আদলে নামকরণ করলেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল! ক্রীড়াপ্রেমীদের মনে ধাক্কা লাগা স্বাভাবিক, কোনটা আসল বিপিএল—ক্রিকেট, না ফুটবল? ক্রিকেটে বিপিএল শুরু হয়েছে আগে। তার ওপর ক্রিকেট এখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তাই ক্রিকেটের বিপিএল যদি বক্স অফিসে সুপারহিট হয়, তাহলে ফুটবল বক্স অফিসে ফ্লপ। কিন্তু কেন বাংলাদেশ ফুটবল লিগ এত দিনেও জনপ্রিয়তা পেল না, সেটা কি ভেবে দেখেন পেশাদার লিগ কমিটির কর্তারা? মনে হয় না। কারণ, প্রতিবার লিগ শুরুর আগে-পরে, মাঝখানে সব সময় তাঁদের মুখ তো টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে। দেশজ ফুটবল মুখ থুবড়ে পড়ুক, তাতে কী! কর্মকর্তাদের মুখ তো দেখানো হয় নিয়মিত টেলিভিশনে!
ফুটবলকর্তাদের চিন্তার দীনতা যখন বেরিয়ে পড়ে, তখন ফুটবল এগোবে কীভাবে? দেশের সর্বোচ্চ লিগের নামের একটা স্বতন্ত্র পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন ফুটবলকর্তারা। সেটা তাঁরা মুখে স্বীকার করুন বা নাই করুন। তবে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য চিন্তা করার লোকও বাফুফেতে নেই, সেটা পরিষ্কার। জাতীয় দলে খেলে ‘সাবেক’-এর তকমা লাগানো একঝাঁক ফুটবলার আছেন বাফুফেতে। দেশজ ফুটবলের ধূসর দিগন্তে তাঁরা এখনো নিজেদের সোনালি দিন খুঁজে বেড়ান! তাঁরা আছেন শুধু ‘আমাদের সময়’ নিয়ে। আগামী দিনের কথা ভাববেন কখন! আসলে তাঁরা ভাবতে পারেন না। আর তাই হাতের কাছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ—বিপিএল নামটাকেই মনে করেছিলেন জাদুর কাঠি। নামটা লাগিয়ে দিলেই আবার জেগে উঠবে আমাদের ফুটবল। তাই পেশাদার ফুটবল লিগের আশ্রয় হলো বিপিএলের কোলে। আর দেশের ফুটবলানুরাগীরাও পড়লেন বিভ্রান্তিতে। নাম বিভ্রাটে। হায় বিপিএল!
কিন্তু বাংলাদেশ ফুটবলকর্তারা কবে বুঝবেন, প্রায় হিমোগ্লোবিনশূন্য হয়ে পড়া দেশজ ফুটবলের নিরাময়ের জন্য ‘বিপিএল’ নাম খুব কার্যকর ওষুধ নয়।
লেখক : জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সাংবাদিক।