বিশ্বকাপ ক্রিকেট
রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার যাবার আগে
এখন পর্যন্ত যা খেলা হয়েছে, তাতে বলে দেওয়া যায়, এটাই বাংলাদেশের সেরা বিশ্বকাপ। ২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ তিনটি জয় পেয়েছিল, গত বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল। সেসব বিবেচনায় নিয়েও বলা যায়, এবারের বিশ্বকাপই সেরা বাংলাদেশের। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বাংলাদেশ শুরু করেছিল বিশ্বকাপ। তারপর হারিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তানকে। নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের সঙ্গে হেরেছে বটে।
তবে আমাকে যদি বলেন, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি ছাড়া আর কোনো পরাজয় নিয়ে আমার কোনো গ্লানি নেই। নিউজিল্যান্ড ও ভারতের সঙ্গে আমরা জিততে পারতাম। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি জেতা সম্ভব ছিল না। অষ্টম ম্যাচে ভারতের সঙ্গে হারার মাধ্যমে আমাদের বিশ্বকাপ কার্যত শেষ হয়ে গেছে। সেমিফাইনালে যাওয়ার স্বপ্ন শেষ। বিশ্বকাপের আগে আমাদের র্যাংকিং ছিল ৭। সেমিফাইনালে যেতে পারলে খুব ভালো হতো। কিন্তু যেতে না পারাতেই সব শেষ হয়ে যায়নি। ক্রিকেটাররা আমাদের মাথা উঁচুই রেখেছে। এটা ঠিক আমরা এবার সেমিফাইনালে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বকাপে গিয়েছিলাম। ৭ নাম্বার দল হয়ে সেরা চারে যেতে চাওয়াটা কারো কারো কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে।
কিন্তু বিশ্বকাপে আমরা দেখিয়ে দিয়েছি, আমরা অবাস্তব স্বপ্ন দেখিনি। এ ধরনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যেকোনো দলকে সামর্থ্যের সেরাটা দিতে হয়। আমরাও তাই দিয়েছি। তবে এ ধরনের অর্জনের জন্য সামর্থ্যের চেয়েও বেশি দিতে হয়। আর কোনো ভুল করার সুযোগ নেই। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে আমাদের বেশ কিছু আফসোস আছে। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে আমরা জয়ের খুব কাছে চলে গিয়েছিলাম। মুশফিক যদি উইলিয়ামসনের সহজ রানআউটটা মিস না করতেন, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচটি যদি বৃষ্টিতে ভেসে না যেত, ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে যদি টস জিতে আগে ব্যাট করার সুযোগ পেতাম, তামিম যদি রোহিত শর্মার ক্যাচটা ফেলে না দিতেন। তবে এ সবকিছুই খেলার অংশ। আফসোস করে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।
বিশ্বকে আমরা দেখিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশ হয়তো সেমিফাইনালে যেতে পারেনি, শিরোপা জেতা হয়নি। কিন্তু সাকিব আল হাসানের নাম কিন্তু সবার ওপরে। ৫৪২ রান, সঙ্গে ১১ উইকেট—বিশ্বকাপে কে কবে এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দেখেছে? মুশফিকের ব্যাটিংও যথারীতি নির্ভরতা দিয়েছে। মুস্তাফিজের জ্বলে ওঠা বা মিরাজ, মোসাদ্দেক, সাইফউদ্দিনের হার না মানা মনোভাব আমাদের গর্বিতই করে। অষ্টম ম্যাচ পর্যন্ত সেমিফাইনালের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখাও কম সাফল্য নয়। সেমিফাইনালে যাওয়ার স্বপ্ন ফুরিয়ে গেলেও আমাদের বিশ্বকাপ কিন্তু শেষ হয়নি।
আজ বিশ্বকাপে আমাদের শেষ ম্যাচ। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। বিশ্ব ক্রিকেটে এখনো পাকিস্তানের যা অবস্থান, সেটা তাদের আনপ্রেডিক্টেবল চরিত্রের জন্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তারা যেমন ১০৫ রানে অলআউট হয়ে যায়, আবার হারিয়ে দেয় ইংল্যান্ডের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে। তাই তাদের মতিগতি বোঝা ভার। তবে শক্তির বিচারে আজকের ম্যাচে বংলাদেশ ফেভারিট। যখন পাকিস্তান ফেভারিট ছিল, তখনো পাকিস্তান জেতেনি। বাংলাদেশ প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল ১৯৯৯ সালে। তখনকার বাংলাদেশ আর এখন বাংলাদেশে আকাশ-পাতাল ফারাক।
প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েই স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে গর্ব করার উপলক্ষ পেয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সেবার পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়ে গোটা বিশ্বকেই চমকে দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেবার পাকিস্তানের দল ছিল দুর্ধর্ষ। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আখতারের গতি তখন যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্য আতঙ্ক ছিল। সাঈদ আনোয়ার, ইনজামাম, শহিদ আফ্রিদি তাঁদের ব্যাটিং লাইনআপও সমীহ জাগানো। সেই দুর্ধর্ষ পাকিস্তান নত হয়েছিল পুঁচকে বাংলাদেশের কাছে। প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েই পাকিস্তানে বিপক্ষে পাওয়া সেই জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনেক এগিয়ে দিয়েছিল। সেই জয়কে পুঁজি করেই পরের বছরই বাংলাদেশ পেয়ে গিয়েছিল টেস্ট স্ট্যাটাস। পাকিস্তানজয়ী সেই স্কোয়াডের তিনজন সদস্য এখন আছেন দলের সঙ্গে। ইনিংস সর্বোচ্চ ৪২ রান করা আকরাম খান এখন বোর্ড পরিচালক। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের নায়ক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু পাকিস্তানের বিপক্ষে করেছিলেন ১৪ বলে ১৪ রান। তিনি এখন বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচক। আর পাকিস্তান-বধের নায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন এখন দলের ম্যানেজার। তাঁরা নিশ্চয়ই তাঁদের উত্তরসূরিদের সেই জয়ের স্মৃতির কথা বলবেন।
১৯৯৯ সালের পুঁচকে বাংলাদেশ যদি ভয়ংকর পাকিস্তানকে হারিয়ে দিতে পারে, তবে এখনকার অসাধারণ বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তান তো নস্যি। আজ কোনো চাপ নেই। আমি চাই বাংলাদেশ আনন্দদায়ক ক্রিকেট খেলুক। যার যা দেনা-পাওনা আছে, সব যেন মিটিয়ে আসে। তামিম ইকবালের একটা সেঞ্চুরি পাওনা হয়ে গেছে। দারুণ শুরু করে সৌম্য বারবার আমাদের আফসোস বাড়ান। আর আফসোস করতে চাই না। মুশফিক অনেক করেছেন। তবুও তিনিই তো আমাদের নির্ভরতা। তরুণরাও নিজেদের সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছেন। তাদের সেই সম্ভাবনা বিকশিত হোক। সাইফউদ্দিনের নায়ক হওয়ার সুযোগ কিন্তু আজও আছে। সাকিবের কাছে আমার প্রত্যাশা অনেক। অবশ্য এই প্রত্যাশা তিনিই সৃষ্টি করেছেন। সাকিব মানেই আকাশ ছোঁয়ার সাধ। সাকিব এখন পর্যন্ত যা করেছেন, তাতেই তার টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হওয়াটা প্রায় নিশ্চিত। তবুও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কারো কারো যেহেতু আরো দুটি বাড়তি ম্যাচ খেলার সম্ভাবনা আছে। তাই আজ শেষ ম্যাচে সাকিব এমন কিছু করুক, যাতে চাইলেও কেউ তাকে ছুঁতে না পারে। বিশ্বকাপে আমার চাওয়া অন্যদের মতো ছিল না। আমি এক বিশ্বকাপে দুটি শিরোপার আনন্দ চেয়েছিলাম। ভারতকে হারাতে না পারায় একটি শিরোপা জয়ের সুযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। আজ পাকিস্তানকে হারাতে পারলেও আমি শিরোপার আনন্দ পাব। আশা করি, বঞ্চিত হবো না। পাকিস্তানকে হারিয়েই শেষ করতে চাই বিশ্বকাপ। শেষ ভালো যার, সব ভালো তার।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।