একজন বীর হাদি বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনার অংশ
একজন মানুষের মৃত্যু সাধারণত একটি পরিবারের শোকের কারণ হয়, কিন্তু কিছু মানুষের চিরবিদায় পুরো জাতির হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। শরিফ ওসমান বিন হাদির তেমনই এক ব্যক্তিত্বে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের ‘বিপ্লবী বীর’ হিসেবে পরিণত হয়েছেন। সন্ত্রাসীর হাতে গুলিতে আহত হয়ে অবশেষে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তাঁর এই শহিদি মৃত্যু জাতির কাছে বেদনাবিধুর ঘটনা। কারণ, তিনি শুধু একজন ব্যক্তি নন, ছিলেন একটি আদর্শের নাম, এক অদম্য চেতনার প্রতীক।
বীর হাদি কথায়, কাজে ও অন্তরে ছিলেন বিপ্লবী। বিভিন্ন সময়ে তিনি যা বলেছেন, যা করতে দেখা গেছে, তাতে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিনি জন্মেছিলেন সংগ্রামের জন্য। অন্যায়, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছিল তাঁর স্বভাব। ভয়ের কাছে নতিস্বীকার করা পরিবেশে হাদি প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বিপ্লব ছিল অন্ধ আবেগের ফল নয়; বরং তা ছিল গভীর চিন্তা, সামাজিক সচেতনতা ও মানবিক দায়বদ্ধতার বাস্তব রূপ।
বাংলাদেশে চলমান রাজনীতির সংজ্ঞা বদলে দিতে চেয়েছিলেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি। জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমরা আসলে প্রশ্ন করা শুরু করি রাজনীতিবিদদের। যে আসবে তাকে জিজ্ঞেস করি—আপনি কী করেন, যদি বলেন রাজনীতি করি। রাজনীতি তো বেতন দেয় না, তবে চলেন কীভাবে? এ প্রশ্ন সবাই শুরু করলে বাধ্য হয়ে এমপি ও মন্ত্রীদের ছোট একটি দোকান হলেও দিতে হবে।’
ভোটারদের সহজ ও সরল পথে উদ্বুদ্ধ করতে হাদি বলেছিলেন, ‘আপনারা প্রতীক দেখে নয়, প্রার্থী দেখে ভোট দেবেন। একজন ভালো মানুষকে একবার ভোট দেবেন, আপনি ও আপনার পরিবার পাঁচ বছর ভাল থাকবে।’
বীর ওসমান হাদি জানতেন, বিপ্লবের পথ কখনো সহজ নয়। তবুও তিনি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিলেন কণ্টকার্কর্ণ এই পথ। ব্যক্তিগত সুখ তাঁর কাছে তুচ্ছ ছিল, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন—ব্যক্তির মুক্তি সমাজের মুক্তির মধ্যেই নিহিত। এই আত্মত্যাগই তাঁকে সাধারণ মানুষের ভিড় থেকে আলাদা করেছে এবং ইতিহাসের উচ্চতায় স্থাপন করেছে। তিনি সংগ্রামের পথে মৃত্যুকে তুচ্ছ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত বুকে বা মাথায় গুলি না লাগবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব না। তবে কেউ আমাদের গুলি করে মেরে ফেললে তাদের ধরে যেন বিচার করা হয়। সেটি করতে না পারলে নতুন কেউ জন্মাবে না।’
আজ যখন আমরা বীর হাদির চিরবিদায়ের কথা ভাবি, তখন এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করি। এই শূন্যতা কেবল একজন বিপ্লবীর অনুপস্থিতি নয়, বরং আদর্শবান নেতৃত্বের অভাবের প্রতিচ্ছবি। তাঁর অনুপস্থিতি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আমরা কি সত্যিই তাঁর স্বপ্নের সমাজ গড়তে পেরেছি? নাকি তাঁর আত্মত্যাগকে কেবল স্মৃতিচারণেই সীমাবদ্ধ রেখেছি?
যদিও বীর হাদির মৃত্যু পরাজয় নয়। কারণ তিনি রেখে গেছেন প্রশ্ন, চেতনা ও দায়বদ্ধতা। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—বিপ্লব মানে ধ্বংস নয়, বিপ্লব মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান। আবেগের পাশাপাশি যুক্তি, সাহসের পাশাপাশি দায়িত্ববোধ—এই সমন্বয়ই ছিল তাঁর সংগ্রামের মূল শক্তি।
রাজনীতিবিদদের হাদি কখনও খাটো করেননি, করেছেন সমালোচনা। কারণ তিনি জানতেন, সমালোচনা মানুষের চোখকে খুলে দেয়, সৎপথে চলতে সহায়তা করে। তিনি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১০ আসন থেকে লড়তে চেয়েছিলেন। যদিও নির্বাচনে জয় প্রত্যাশায় মরিয়া ছিলেন না। সেকথাও তিনি তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘নির্বাচন করলে জিতব এটিই প্রথম কথা নয়। তবে রাজনীতিতে তরুণদের সামনে নিতে চাই। এই রাজনীতিতে আগামী ৫০ বছরে জিততে বা নাও জিততে পারি। তবে আমরা নতুন একটি ধারা তৈরি করতে চাই। লম্বা সময় রাজনীতি করতে আসিনি, রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তনের জন্য আসছি। আমাদের হায়াত ও জীবনে পারব কিনা জানি না। তবে নিশ্চিত এটি জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।’
হাদি তার ছোট্ট কিন্তু পরোক্ষ লম্বা ও কঠিন বিপ্লবী পথে তার পরিবারকে ভোলেননি। তবে, পরিবাবের কথায় পিছপা হননি। যখন তার চারপাশ হুমকিতে পরিপূর্ণ, তখনও তিনি অটল থেকেছেন। একটি পর্যায়ে শুধু এতটুকু চেয়েছেন, ‘আল্লাহ যদি আমাকে নিয়ে যায়, আমার বাচ্চাটার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।’
বীর হাদির চিরবিদায় আমাদের চোখ ভিজিয়ে দেয়, কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের মনের গভীরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সেই আগুন অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর, সত্যের পক্ষে কথা বলার। তিনি নেই, তবুও তাঁর আদর্শ বেঁচে থাকবে—যতদিন মানুষ ন্যায়ের সন্ধান করবে।
বিপ্লবী বীর হাদি মৃত্যুর মাধ্যমে নীরব হয়েছেন, কিন্তু ইতিহাসের কণ্ঠে তিনি চিরকালের জন্য উচ্চকিত। তাঁর চিরবিদায় শোকের, কিন্তু তাঁর জীবন আমাদের জন্য এক অমর প্রেরণা। তাঁর মৃত্যু আমাদের কেবল শোকাহতই করে না, আমাদের বিবেককেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়।

ইলিয়াস হাফিজ