খালেদা জিয়া : আপসহীন সংগ্রামের মহাকাব্য
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের এক আপসহীন নেতৃত্বের চিরবিদায় ঘটল। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পথচলায় তিনি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন, গড়েছেন শক্ত মানসিকতার কর্মী। তিনি মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার সুনেতৃত্বে এগিয়ে বাংলাদেশ, সম্পর্কের সেতু বিস্তৃত হয়েছে এক উপসাগর পারি দিয়ে অন্য মহাসগরে। তিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
আপসহীন সংগ্রামের মহাকাব্যের এই রচয়িতা দীর্ঘ রোগভোগের পর ৮০ বছর বয়সে আজ মঙ্গলবার (৩০ ডিম্বের) ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে দেশে, শোকবার্তা জানিয়েছেন বিশ্বনেতৃত্ব। তার মৃত্যুকে ঘিরে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন নিয়ে শুরু হয়েছে গভীর চর্চা। কাতার ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা প্রকাশ করেছে একটি প্রতিবেদন, শিরোনাম দিয়েছে ‘খালেদা জিয়া, বাংলাদেশ’স ফার্স্ট উইমেন পিএম : অ্যা লাইফ অব পাওয়ার অ্যান্ড রেজিজস্ট্যান্স’। সেখানে লেখা হয়েছে, ডিসেম্বরের শুরু থেকেই এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে ৪৮ বছর বয়সী টিপু সুলতানের মতো হাজারো তৃণমূল কর্মী ভিড় করেছিলেন। বাংলাদেশের একজন টিপু সুলতানের হাতে থাকা সেই ভাইরাল প্ল্যাকার্ড—‘আমি বেগম খালেদা জিয়াকে আমার কিডনি দান করতে চাই’—হয়ে উঠেছিল কোটি ভক্তের আবেগ ও ভালোবাসার প্রতীক। টিপু বলেছিলেন, ‘তিনি আমার মায়ের মতো। গণতন্ত্রের জন্য তিনি সবকিছু ত্যাগ করেছেন।’ ভক্তদের প্রার্থনা ছিল ১২ ফেব্রুয়ারির আসন্ন নির্বাচনটি যেন তিনি দেখে যেতে পারেন, কিন্তু নিয়তির লিখন ছিল ভিন্ন।
অন্দরমহল থেকে রাজপথ
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে জন্ম নেওয়া খালেদা জিয়া রাজনৈতিক যাত্রা ছিল অপ্রত্যাশিত। ১৯৬০ সালে জিয়াউর রহমানের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। সে সময়ে জিয়া ছিলেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। ১৯৮১ সালে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত খালেদা ছিলেন একজন নিভৃতচারী গৃহিণী।
তৎকালীন সহকারীদের ভাষ্যমতে, ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোরে যখন স্বামী নিহত হওয়ার খবর আসে, তখন খালেদা জিয়া ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু জিয়ার রেখে যাওয়া ভঙ্গুর বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করতে দলের সিনিয়র নেতারা তাঁর ওপরই আস্থা রাখেন। ১৯৮২ সালে সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগ দিয়ে ১৯৮৪ সালে তিনি দলের হাল ধরেন। এরপর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর ‘আপসহীন’ নেতৃত্ব তাঁকে গণতন্ত্রের প্রতীকে পরিণত করে।
খালেদা জিয়ার ক্ষমতা ও শাসন
১৯৯১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে খালেদা জিয়া ইতিহাস গড়েন। বাংলাদেশে প্রথম কোনো নারী এই প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে দেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করে। তাঁর শাসনকাল সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘তিনি চেয়েছিলেন তাঁর স্বামীর জাতীয়তাবাদী দর্শনে দেশ গড়তে।’
খালেদা জিয়ার সময়ে অর্থনৈতিক উদারীকরণ, পোশাক খাতের বিকাশ, নারী শিক্ষার প্রসার ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশে উন্নীত হওয়া উল্লেখযোগ্য। বিশ্বব্যাংক তখন বাংলাদেশকে ‘এশিয়ার পরবর্তী বাঘ’ হিসেবে অভিহিত করেছিল।
১৯৯৫ সালের সারের সংকট, ২০০১-২০০৬ মেয়াদে ‘হাওয়া ভবন’ কেন্দ্রিক দুর্নীতির অভিযোগ ও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনাগুলো তাঁর প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল।
প্রতিরোধ ও ত্যাগের রাজনীতি
খালেদা জিয়ার জীবন ছিল ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কষ্টের এক দীর্ঘ ইতিহাস। ২০০৮ সাল থেকে বড় ছেলে তারেক রহমান নির্বাসিত, ২০১৫ সালে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যু এবং ২০১৮ সাল থেকে দুর্নীতির মামলায় জেল ও গৃহবন্দীত্ব—সবই তিনি সহ্য করেছেন দেশের কথা ভেবে। সুযোগ তৈরি হলেও দেশ ছেড়ে যাননি কখনোই।
ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমেদের মতে, ‘খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাঁর অটল অবস্থান। ২০০৭ সালের ১/১১-এর সময় বা পরবর্তী সময়ে চাপের মুখেও তিনি দেশ ছাড়তে রাজি হননি। এই জেদই বিএনপিকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে।’ এমনকি ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর যখন তিনি মুক্তি পান, তখনও তিনি সমর্থকদের প্রতি প্রতিশোধ না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাজনৈতিক মহত্ত্বের পরিচয় দেন।
ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠন
খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালীন তার নেতৃত্বের চেইন অব কমান্ড তৈরি করেছেন। দলের ভেতরে এনেছেন নানা পরিবর্তন, যা তার দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করেছে সব সময়। তিনি রেখে গেছেন তার নেতৃত্বের উত্তরাধিকার। এজন্য তার প্রয়াণের পর বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। উপযুক্ত নেতৃত্বে আছেন দলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ ১৭ বছর লন্ডনে নির্বাসিত থাকার পর গত ২৫ ডিসেম্বর তিনি দেশে ফিরেছেন।
জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি
খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্ব কোনো অন্যায়কে সহ্য করেনি। নির্যাতন সহ্য করেও দূরে থেকেছেন পাতানো নির্বাচন থেকে। অবশেষে গত বছর হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে বিএনপি। ঠিক তার আগমুহূর্তে দলীয় প্রধানের মৃত্যু বিএনপিকে এক গভীর আবেগময় ও চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়েছে। যদিও সেই পরিস্থিতি উতরে যাবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ, খালেদা জিয়ার জীবন দলীয় নেতাকর্মীদের শিখিয়েছে, কীভাবে দেশের মানুষের পাশে থাকতে হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তারেক রহমানের সামনে এখন বড় পরীক্ষা হলো তাঁর মায়ের রেখে যাওয়া ‘আপসহীন’ উত্তরাধিকারকে ধারণ করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য বজায় রাখা হবে তাঁর প্রধান কাজ।
খালেদা জিয়া কেবল একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না; তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কোটি মানুষের কাছে এক অটল অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এবং জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগ্রত করতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। দেশের মানুষ তাঁকে মনে রাখবে এমন একজন নেত্রী হিসেবে, যিনি বারবার ভেঙে পড়েছেন কিন্তু কখনো মচকাননি।

রাসেল মাহমুদ ভূঁইয়া