‘সোনাবন্ধু’ ‘লাল কুর্তাওয়ালা’কে সাড়ম্বরে মনে রাখা জরুরি
‘সোনাবন্ধু তুই আমারে করলিরে দিওয়ানা’—গানটি শুনলে কার মন না দুলে ওঠে! অথচ কতোজন এই গানের স্রোষ্টার নাম মনে রেখেছেন? গানের এই স্রোষ্টার আরও একটি গানের কথা বলি—‘রসিক দিলকা জ্বালা/ও লাল কুর্তাওয়ালা/দিলে বড় জ্বালারে পাঞ্জাবিওয়ালা’। যেকোনো স্থানেই এই কলি কয়টি গেয়ে উঠুন, নিশ্চিত নেচে উঠবেন সেখানের শ্রোতারা। সরবে জনমনের প্রাঙ্গণে গানে-গানে সরব যে কবি, জনসাধারণের সেই অঙ্গনেই নামে অতি অপরিচিত এই নক্ষত্র। তিনি আর কেউ নন, আবদুল গফুর হালী। তার জন্ম কিংবা মৃত্যু দিন যেন কেটে যায় যেন নীরবে-নির্ভতে। এবারের ২১ ডিসেম্বরটিও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তার আরও একটি গানের কয়েকটি কলি মনে করিয়ে দিয়ে প্রশ্ন রাখতে চাই, আসলেই ঠিক হচ্ছে—‘মনেরও বাগানে ফুটিল ফুলরে/রসিক ভ্রমর আইলো না/ফুলের মধু খাইলো না’।
গ্রামেগঞ্জে, পথে-প্রান্তরে, ঘরে কিংবা বাইরে, মঞ্চে-মঞ্চে গানের ডালিতে আছেন আবদুল গফুর হালী। মুর্শিদি, মারফতিসহ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও মাইজভান্ডারি মিলিয়ে তার লেখা গানের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। মনে রাখার মতো অসংখ্য গানের মধ্যে আরও আছে—‘কত খেলা জানোরে মাওলা’, ‘অ শ্যাম রেঙ্গুম ন যাইও, বানুরে অ বানু’, ‘তুঁই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু মাছ মারিবার লাই’, ‘বইনদ্দি নওশিরো, নিশিরও কালে’ ইত্যাদি।
বলাকা প্রকাশন থেকে ২০১২ সালে প্রকাশিত শামসুল আরেফীনের লেখা বই ‘বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় লোকসঙ্গীত‘ বলছে, আস্কর আলী পণ্ডিতের ভাবশিষ্য ছিলেন হালি গান ছাড়াও রচনা করেছেন একাধিক চাটগাঁইয়া নাটক।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, শৈশবকালে আবদুল গফুর হালী গায়ক ও গীতিকার আসকার আলী পণ্ডিতের কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। পরে মওলানা বজলুল করিম কাঞ্চনপুরী, মাওলানা আবদুল হাদি এবং রমেশ শীলের মতো মাইজভান্ডারী সুফি গায়কদের দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে হারমোনিয়াম শিখেননি, তবে তাদের কাজ অনুসরণ করতেন। আরেকটি তথ্যে জানা গেছে, তরুণ বয়সে বিয়ের পর তিনি ভাবসংগীতের জগতে আসেন। পেশাগতভাবে তিনি তার বাবার ব্যবসায় মনোযোগ দেন।
১৯২৮ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের পটিয়ার রশিদাবাদে এই গীতিকবি, সুরকার ও সাধকশিল্পীর বাবা আবদুস সোবহান এবং মা গুলতাজ খাতুন। রশিদাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জোয়ারা বিশ্বম্বর চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয় থেকে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। তবে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত একাডেমিক শিক্ষা অর্জনের পর ইস্তফা দেন।’
মাসুম আলী তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, “তাঁর নাম আবদুল গফুর, ‘হালী’ তাঁর মুর্শিদের দেওয়া উপাধি।” তিনি তার নিবন্ধে আরও জানান, “তাঁর (হালী) মতে, ভাব আসে প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতিই তাঁর গুরু। এক স্মৃতিচারণায় তিনি জানিয়েছিলেন, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কারণে লেখাপড়া করা হয়নি তাঁর। চোখের সামনে মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। সে সময় জাপান-জার্মানির যুদ্ধ চলছে। এসব কিছু তাঁর ভাবনার জগৎকে বদলে দিয়েছিল।”
২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর তার প্রয়াণ দিবস। আবদুল গফুর হালীর জন্মদিনে বা প্রয়াণ দিবসে কিছু ব্যক্তিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি দিয়ে স্মরণ করতে দেখা যায়। অথচ দেশের বাইরে, বিশেষ করে জার্মানিতে রয়েছে তার অকুণ্ঠ সম্মান। জার্মানির হালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতবর্ষ-বিষয়ক দর্শন শাস্ত্রের সহকারী অধ্যাপক হানস হার্ডার বাংলাদেশ ভ্রমণের ১৫ বছর পর ২০০৪ সালে ‘ডর ফেরুখটে গফুর স্প্রিখট’ বা ‘পাগলা গফুর বলে’ শিরোনামে গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনি আবদুল গফুর হালীর ৭৬টি গানকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। যদিও বর্তমানে ইতিবাচক দিক হলো—আবদুল গফুর হালীর গানের সংরক্ষণ ও প্রচারে আবদুল গফুর হালী রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আবদুল গফুর হালীর গান গেয়ে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন বাংলাদেশের অনেক শিল্পী, কাঁপিয়েছেন দেশ-বিদেশের মঞ্চ। অথচ দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত ছিলেন হালী। পাননি রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এই মাটিতে শিল্পসাহিত্যের এমন একজন তারকাকে কীভাবে স্মরণযোগ্য তা আজকের পাঠকরাই নির্ধারণ করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করি। আবদুল গফুর হালি বেঁচে থাকুক, নাড়া দিক, আলোকিত থাক—এটাই প্রত্যাশা।

আলিফ আশরাফ