ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা : বাস্তবতা ও সম্ভাব্য সমাধান
ট্রাফিক বাতির ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়—শহুরে জীবনের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মানুষ কতটা পরিশ্রম করেছে। লন্ডনের ১৮৬৮ সালের গ্যাসচালিত বাতি থেকে শুরু করে আজকের সেন্সর-নির্ভর স্মার্ট সিগন্যাল—সবই ছিল এক ধারাবাহিক উন্নয়নের ফল। কিন্তু প্রযুক্তি থাকলেই সমস্যা মিটে যায় না; প্রয়োগ, রক্ষণাবেক্ষণ, আইন প্রয়োগ এবং নাগরিক আচরণ—সব মিলিয়ে একটি কার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এখাতে বাংলাদেশ কতোটা এগোলো?
বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বেশ কিছু মোড় শোভা পাচ্ছে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট। এই প্রযুক্তি যানজট কমাতে ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সাহায্য করবে বলে মনে করা হয়েছিল। তবে, পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য, লাল বাতি জ্বলে থাকলেও প্রধান সড়কে দেখা যাচ্ছে, যানবাহন চলছে। আবার সবুজ বাতি জ্বললেও ট্রাফিক হাত উঁচু করে সিগন্যাল দিচ্ছেন—দাঁড়িয়ে থাকার। সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে, বিশেষত ঢাকায়, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, যানবাহনের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও সড়ক অবকাঠামো ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সেই হারে আধুনিক হয়নি। ফলে গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ট্রাফিক লাইট, সয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল থাকলেও তা অকার্যকর বা অমান্যযোগ্য হয়ে পড়েছে। ফলে প্রতিদিন ট্রাফিক জ্যামের কারণে কোটি কোটি টাকার কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় বলে বিভিন্ন গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
কতোটা পিছিয়ে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশ, বিশেষত ঢাকা শহর, নানা কারণে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সমস্যায় জর্জরিত। পরিকল্পনা ঘাটতির পাশাপাশি আছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সিগন্যালের অকার্যকারিতা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, শৃঙ্খলা ও আইন প্রয়োগের অভাব রয়েছে এখানে। এ ছাড়া আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সিং সিস্টেমের নেতিবাচক দিকও রয়েছে।
অবকাঠামো ও সিটি প্ল্যানিংয়ের ঘাটতি
শহরের রাস্তাগুলো প্রাথমিকভাবে সেই গতি বা ভলিউম সামলানোর জন্য ডিজাইন করা হয়নি যা আজকার গাড়ি ও মানুষের চাপ। রাস্তার প্রস্থ সীমিত, শাখা-প্রশাখা কম। সার্বিক নগর পরিকল্পনা দুর্বল—এগুলো ঘন জ্যাম তৈরি করে। ফুটপাতের ব্যাপক দখল পথচারীদেরকে সড়কে নামিয়ে আনে, ফলে গাড়ি ও মানুষ একই জায়গায় সংঘর্ষ ছড়ায়।
সিগন্যালের অকার্যকারিতা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব
চোখে পড়বে এমন অনেক সিগন্যাল আছে যা আছে—তবে কাজ করে না, বা আলো একেবারে অপ্রাসঙ্গিকভাবে স্থির হয়ে থাকে। রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় লাইট ভাঙে ও দিকনির্দেশের ত্রুটি তৈরি হয়। কারিগরি ত্রুটিকে মানুষ দুর্বল আইনের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়; ফলে সিগন্যালকে কেউ তেমন মনে রাখে না।
শৃঙ্খলা ও আইন প্রয়োগের অভাব
লেন মেনে চলার সাংস্কৃতিক অভ্যাস যথেষ্ট উন্নত হয়নি। ছোট থেকে বড়—সবার মধ্যে একই নিয়ম নেই। পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও তাত্ক্ষণিক, স্বচ্ছ ও ডিজিটাল শাস্তি ব্যবস্থার অভাব আছে; জরিমানা কাটলেও সেটি অনুকূল প্রয়োগ হয় না বা দুর্নীতির কারণে কাগজেই আটকে থাকে।
চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সিং সিস্টেমের নেতিবাচক দিক
লাইসেন্সিং অনেকসময় কাগজি প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়। বাস্তব চালনার দক্ষতা যাচাইয়ে যে মানদণ্ড থাকা উচিত তা অনেক ক্ষেত্রেই নেই। ফলে অনভিজ্ঞ চালক সড়কে বেড়ায়।
আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জ
দ্রুত নগরীকরণ, বাড়তি ব্যক্তিগত যানবাহন পোশাক, সস্তা প্রবেশাধিকার—এসব কারণ শহরে বেশি গাড়ি নিয়ে আসে। একই সাথে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেশি হওয়ায় রাস্তায় চলাচল সারাদিনই তীব্র থাকে।
যানজট যেভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিকখাতে প্রভাব ফেলে
ট্রাফিক জ্যাম কেবল অসুবিধা নয়—এটি দেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করে। কর্মঘণ্টা নষ্ট, জ্বালানি অপচয়, পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি, জরুরি সেবার বিলম্ব—এসব কারণে সরাসরি আর্থিক ক্ষতি হয়। অফিসে দেরি, পণ্য সরবরাহে বিলম্ব এবং রোগীর অ্যাম্বুল্যান্সে বিলম্ব—এসব মিলিয়ে সমগ্র শহর ও দেশের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।
বহির্বিশ্বের তুলনা : শেখার জায়গা
বহির্বিশ্বের অনেক শহরই একই সমস্যা সামলিয়েছে, কিন্তু যারা সফল হয়েছে তাদের কিছু সাধারণ নীতি আছে। যেমন : সিঙ্গাপুর, লন্ডন, দক্ষিণ কোরিয়ার সিওলে বিকল্প গণপরিবহণ ব্যবস্থা উন্নয়ন, অর্থাৎ মেট্রো, বিআরটি ও দক্ষ বাস নেটওয়ার্ক তৈরি করে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে। সিঙ্গাপুর, হংকংয়ে কঠোর আইন ও ডিজিটাল এনফোর্সমেন্ট রয়েছে। ফলে ক্যামেরা-ভিত্তিক চালান, লাইসেন্স পয়েন্ট সিস্টেম এবং রিয়েল-টাইম ট্রাফিক মনিটরিং কার্যকর ঘাটতি কমাচ্ছে। এ ছাড়া লন্ডন ও নিউইয়র্কে ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ফ্লো অ্যানালাইসিস, ডাইনামিক লাইটিং—এসব কৌশল ট্রাফিক ফ্লো-কে জটিলতামুক্ত করছে, সহজ করছে।
জার্মানি ও জাপানে নাগরিক সচেতনতা ও শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। দেশ দুটিতে স্কুল-ভিত্তিক ট্রাফিক শিক্ষা ও নিয়ম-আচরণ বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেছে।
বাস্তবসম্মত সমাধান ও প্রয়োগযোগ্য রোডম্যাপ
নাগরিক সচেতনতা ছাড়া শুধু নিয়ম ও আইনের শিকলে যানজটের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। যদিও এর পাশাপাশি আরও বেশ কিছু নিয়ামক প্রয়োজন। সেগুলো ছাড়ও শুধু নাগরিক সচেতনতা এই সমস্যাকে সমাধান করবে না। এখানে কিছু কৌশল তুলে ধরা হলো, যা দ্রুত, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
স্বল্পমেয়াদি
রক্ষণাবেক্ষণ ও অবকাঠামো ঠিক করলে কিছুটা সমস্যার সমাধান হতে পারে। অচল সিগন্যাল পুনরায় চালু করা, কেজুয়াল রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি; প্রধান মোড়ে জরুরি মেরামত। ক্যামেরা ও ডিজিটাল নজরদারি বর্ধিত করতে হবে। লেন লংঘন, রেড লাইট ভায়োলেশন ক্যাচ করার জন্য ক্যামেরা বসানো; ডিজিটাল টিকিটিং পদ্ধতি চালু করতে হবে। পাইলট স্মার্ট লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কয়েকটি ব্যস্ত মোড়ে সেন্সর-নির্ভর বক্স বসিয়ে ট্রায়াল করা—যেখানে লাইট সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে।
মধ্যমেয়াদি
বিআরটি ও গণপরিবহণ সম্প্রসারণ করতে হবে। একইসঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ি কেনায় অনুমোদন কমাতে হবে। নির্দিষ্ট করিডরে বাস লেন, দক্ষ টিকেটিং ও সময়সূচি নিশ্চিত করতে হবে। স্কুল-কলেজে ট্রাফিক শিক্ষা, গণমাধ্যম ক্যাম্পেইন ও করপোরেট অংশীদারিত্ব। ডিজিটাল ফাইন ও পিন পয়েন্ট সিস্টেম গড়া যেতে পারে। এতে আইন ভঙ্গের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় অর্থপ্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি
AI, রিয়েল-টাইম ডেটা ও সেন্ট্রাল অপারেশনস—বিশাল ট্রাফিক ডেটা হাব। নগর পরিকল্পনায় যানসংখ্যার পূর্বাভাস, নতুন রুট ও পার্কিং নীতি। স্থায়ী ফুটপাত, ওভারব্রীজে সহজ অ্যাক্সেস, বিকল্প মোবিলিটি (সাইকেল লেন।
বাজেট ও বাস্তবায়ন : কে কী করবে?
সরকার: নীতিগত সিদ্ধান্ত, বড় প্রকল্প (মেট্রো, বিআরটি), আইন পরিবর্তন।
স্থানীয় প্রশাসন/সিটি করপোরেশন: রক্ষণাবেক্ষণ, সিগন্যাল স্থাপন ও চালানো, স্থানীয় প্রয়োগ।
বেসরকারি খাত: প্রযুক্তি প্রদানকারী, সেবা মেইনটেন্যান্স, পিপিপি মডেলে ইনভেস্টমেন্ট।
নাগরিক সমাজ: সচেতনতা বৃদ্ধি, পথচারী ভূমিকা, রিপোর্টিং।
বাজেট নির্ভর করবে প্রকল্প আকার ও প্রযুক্তির ওপর; তবে ছোট-খাট একাধিক পাইলট করে দ্রুত লাভ দেখিয়ে বড় বিনিয়োগের জন্য রাজি করানো সম্ভব।
সর্বপরি, ট্রাফিক শুধু নগর জীবনের সমস্যাই নয়—এটি একটি সামগ্রিক শাসন, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও নৈতিকতার প্রশ্ন। বাংলাদেশের সামনে এক অসুবিধা নয়, সুযোগও রয়েছে: জনসংখ্যা ঘনত্বকে কাজে লাগিয়ে দক্ষ গণপরিবহণ, ডিজিটাল এনফোর্সমেন্ট এবং সংস্কৃতিগত পরিবর্তন এনে আমরা দ্রুত এগোতে পারি। শিল্পায়ন ও নগরায়নের এই যুগে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা যদি আমরা জাতীয় অগ্রাধিকার করি, তবে শহরগুলো হবে নিরাপদ, দক্ষ ও মানবিক—এটাই সম্ভাব্য বাস্তবতা।

হিমাদ্রি মাহি