জন্মভূমির বাইরে ‘আটকে পড়া’ এক শহীদ বুদ্ধিজীবী!
বড় নামডাক না থাকলে এ দেশে অনেক কৃতী মানুষের জন্ম বা মৃত্যুতিথি অনেক সময় অগোচরে আসে, আর অগোচরেই চলে যায়। তাঁদের স্মরণ করার সময় হয়ে ওঠে না যে রাষ্ট্র ও সমাজের; এমন সময় এ বছরও চলে যাচ্ছে একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর মৃত্যুদিবস; যিনি দেশের জন্য জীবন দিলেও এখনো জায়গা পাননি জন্মভূমিতে, পড়ে রয়েছেন দেশের বাইরে! আর তাঁকে স্মরণ-শ্রদ্ধা তো দূরের কথা, তাঁর নিজ জেলায় অধিকাংশ মানুষই জানে না দেশের জন্য তাঁর আত্মত্যাগের কথা! তাদের কাছেই অচিন তিনি!
২. শহীদ এই বুদ্ধিজীবীর নাম আবদুল ওয়াহাব তালুকদার। তিনি ছিলেন কুড়িগ্রাম কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক। একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের শেষ দিকে তিনি কুড়িগ্রাম শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি ভূরুঙ্গামারীতে চলে যান। ২৫ মার্চের কিছুদিন পর তিনি ভারতে গিয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। পরে ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন বামনহাট যুব শিবিবের ক্যাম্প ইনচার্জ নিযুক্ত হন। ৭ আগস্ট সকালে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন বগনী রেলসেতুতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলকে দেখতে এসেছিলেন তিনি। এ সময় তাঁরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে আক্রান্ত হন। তিনি গুলিতে আহত হন। সেখানে রেললাইন ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ। তিনি দৌড়ে জঙ্গলে আত্মগোপন করলে সেনারা জঙ্গল থেকে তাঁকে খুঁজে বের করে। সেখানেই তাকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। সে সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত আক্রমণে তাঁকে কোনোক্রমেই বাংলাদেশের মাটিতে সমাহিত করা সম্ভব না হওয়ায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছে ভারতের কালামাটি গ্রামে বগনি নদীর তীরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। সেখানেই অযত্ন-অবহেলায় নিভৃতে শুয়ে আছেন তিনি।
৩. আবদুল ওয়াহাব তালুকদার যে দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে নিভৃতে দেশের বাইরে শুয়ে আছেন, সে দেশও ভুলে গেছে তাঁকে। যে কুড়িগ্রাম কলেজের (বর্তমানে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ) শিক্ষার্থীদের তিনি প্রিয় শিক্ষক ছিলেন, সেই কলেজের ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে কতজন তাঁর সম্পর্কে জানেন সেটাও এখন গবেষণার বিষয়। কলেজে তাঁর নামে একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হলেও শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানে না কে সেই আবদুল ওয়াহাব তালুকদার? তাঁর অবদানই বা কী। তাঁর মৃত্যুদিবসে কলেজে আগে একটি স্মরণসভা হলেও এখন আয়োজন করার যেন কেউ নেই! আর ১৯৯৭ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে তাঁর নামে একটি স্মারক ডাকটিকেট উন্মোচন করে নিজের দায়িত্ব শেষ করেছে সরকার!
৪. দেশ স্বাধীনের ৪৬ বছর পার হলো। আর কয়েক বছর পর আমরা উদযাপন করব স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এমন মাহেন্দ্রক্ষণে যদি একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীকে আটকে পড়ে থাকতে হবে সীমান্তের ওপারে অযত্ন-অবহেলায়, তাহলে কেমন হবে আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির উৎসব-আনন্দ? মুক্তিযুদ্ধের সময় পরাধীন দেশের মাটি তিনি পাননি বলে আমরা কি তাঁর অন্তঃআত্মাকে স্বাধীনতার সোঁদা মাটির গন্ধে একটু নিশ্বাস নিতেও দিব না? এ নিয়ে শহীদজায়া মেশেরুন নাহারের আক্ষেপ, ‘২০০৭ সালে সরকার হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ শেষে ফিরিয়ে আনলে তাঁরাও আবেদন করেন। কিন্তু এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। মুক্তিযুদ্ধের গবেষক অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল সাজ্জাদ জহির অনেক চেষ্টা করেছেন। বাকিটা সরকারের স্বদিচ্ছার ওপর। সরকার আন্তরিক হলেই তাঁর দেহাবশেষ দেশে আনা সম্ভব।’ একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে এনে তাঁকে সম্মানে সমাধিস্থ করতে খুব কি বেশি দাবি করেছে পরিবার?
৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় বিনু স্বপ্নে দেখেছিল কলকাতা শহর নড়তে নড়তে চলছে এবং আজগুবি ওলটপালট সব কাণ্ড ঘটছে, তবে শেষ পর্যন্ত বিনুর ঘুম ভাঙে স্তস্থির সঙ্গে, না কলকাতা আছে কলকাতাতেই? কিন্তু আমাদের শহীদরা যে স্বপ্ন নিয়ে জীবন দিয়েছিলেন সেই বাংলাদেশ কি আছে বাংলাদেশে? থাকলে কি আবদুল ওয়াহাব তালুকদারের মতো শহীদের ছাড়াই? তাঁদের সীমান্তের ওপারে রেখেই?
সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি!
লেখক : সাংবাদিক, নিউজ টোয়েন্টিফোর টেলিভিশন, ঢাকা।
স্কেচ : শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকেট ( ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৭ সাল)।