সেপ্টেম্বর অন নাফ রিভার
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/09/17/photo-1505632340.jpg)
ওপারে মিয়ানমার, এপারে বাংলাদেশ। মাঝখানে বয়ে চলেছে নাফ রিভার। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে আলাদা করা ছোট্ট পানির বয়ে চলার পথ নাফ। এই নাফ নদ দিয়েই কখনো সাঁতার কেটে, কখনো নৌকায় উখিয়ার দামনখালি সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা।
নাফ নদ পার হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখা যাচ্ছে কারো মাথায় ঝুড়ি, কেউ কাপড়চোপড় নিয়ে হাঁটছে। খুঁজছে আশ্রয়স্থল। কেউ খাবারের টাকার জন্য হাত পাতছে। শরণার্থী শিবিরগুলোয় প্রয়োজনীয় খাবার আর পানির অভাবে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাদের জীবন। কোনোমতে নিজেদের জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিলেও তারা ক্ষুধা-তৃষ্ণার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার পথ পাচ্ছে না। এ দৃশ্য যেন ১৯৭১ সালের সেই ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর’ রোডের প্রতিচ্ছবি।
নাফ নদের পশ্চিম তীরে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, পূর্বপাশে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য, যা রাখাইন বলেও পরিচিত। এ রাজ্যে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বাস। যারা কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্র ও বন্ধুহীন এবং ভুলে যাওয়া জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। তাদের ওপর সেখানকার সেনাবাহিনী চালাচ্ছে অমানবিক নির্যাতন।
নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাতের পর গত ২৫ আগস্ট থেকে টেকনাফ ও বান্দরবন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে মতো আসা শুরু করেছে বিশ্বের সবচয়ে নিপীড়িত এই জনগোষ্ঠী। এ দৃশ্য শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর তৈরি করা প্রামাণ্যচিত্রে দেখা যায়। এ যেন সেই সেপ্টেম্বর। ১৯৭১ সালে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ বাংলাদেশি যেমন যশোর রোড দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তেমনি নাফ রিভার পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শুরু করেছে রোহিঙ্গারা।
নাফ নদে আগে হাজারো নৌকা মাছ ধরত। এখন নিষেধাজ্ঞার কারণে নদীতে নৌকা থাকছে না। দু-একটি নৌকা সংগ্রহ করা গেলেও তাতে গাদাগাদি করে রোহিঙ্গারা উঠে পড়ে। ফলে একাধিক নৌকাডুবির ঘটনা ঘটছে। এ জন্য তাঁর মতো অনেকে নাফ নদ সাঁতরে এপারে চলে আসছে। রাখাইন রাজ্যের তুলাতলী গ্রামে নাফ নদের প্রশস্ততা ও গভীরতা কম। ভাটার সময় পুরুষদের গলাসমান পানি থাকে। ফলে হেঁটে কিংবা সাঁতরে ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে পার হওয়া যাচ্ছে। এতে নারী ও শিশুদের অনেকে এই পানিতেও ভেসে যাচ্ছে। তাদের অধিকাংশের শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে ২০টির বেশি চৌকিতে একযোগে সন্ত্রাসী হামলার পর সেখানে সান্ধ্য আইন জারি করে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করে সে দেশের সেনা ও পুলিশ। রাখাইন রাজ্যের মংডু জেলার ঢেকিবুনিয়া, চাকমাকাটা, ফকিরাবাজার, কুমিরখালী, বলীবাজার, টংবাজার, সাহাববাজারসহ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অন্তত ২৫টি গ্রাম এখন মানুষশূন্য। এসব গ্রামের ৯০ শতাংশের বেশি ঘরবাড়ি আগুনে ধ্বংস করা হয়েছে। তাই শেষ রক্ষা পেতে নাফ নদ পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে তারা।
নাফ নদে প্রতিদিন দেখা মিলছে নারী, শিশু ও পুরুষের লাশ। লাশের পচা গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। শিয়াল-কুকুরের খাওয়া লাশের হাড়গোড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিলের ধারে ও নদীর পাড়ে। বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সকালে আরো সাত লাশ পাওয়া গেছে নদীটিতে। এই নিয়ে গত ২৫ আগস্ট থেকে বুধবার পর্যন্ত লাশের সংখ্যা দাঁড়াল ১০২-এ।
সম্প্রতি বাংলাদেশে পালিয়ে আসা অনেক রোহিঙ্গার শরণার্থী ক্যাম্পে ঠাঁই হচ্ছে না। ৫০ থেকে ৭০ মাইল দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সন্তান তার বাবা-মাকে কাঁধে করে কুতুপালং ক্যাম্পে নিয়ে এসেছেন। থাকার জায়গার অভাবে রাস্তার পাশে অবস্থান নিয়েছে শত শত পরিবার।
উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়কের দুপাশে এখন রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। এরা সবাই নাফ নদ পার হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গত ১৮ দিনে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা এই নাফ নদ পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। দুই চোখ যেদিকে যাবে, শুধু মানুষ আর মানুষ দেখা যাবে। কোলে শিশু নিয়ে, কাঁধে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে ছুটছেন আশ্রয়ের আশায়। সম্বল বলতে পরনের কাপড় ছাড়া কিছু নেই তাদের। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রোমাসহ বিভিন্ন এলাকায় কয়েক দিন ধরে আসা রোহিঙ্গারা অনেকে এখন দেশের মূল জনস্রোতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি দেশের সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নসহ সাধারণ জনগোষ্ঠীর মাঝেও এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সড়কে খাদ্যবাহী কোনো গাড়ি দেখলে পেছন পেছন ছুটছে তারা। কোনো গাড়ি দেখলেই সেই গাড়ি থামিয়ে খাবার আর পানির আকুতি জানাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এদের মধ্যে নারী-শিশুর সংখ্যা বেশি। নারীরা তাদের সন্তানদের দেখিয়ে খাবার চাইছেন।
নাফ নদের ওপার থেকে পাহাড় বেয়ে ভেসে আসতে শুরু করে বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দ। পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামগুলো থেকে আগুনের ধোঁয়া এসে মিশছে বাতাসে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে শূন্যে ছুড়ছে সেনারা। কখনো কখনো কেটে ফেলা হচ্ছে তাদের গলা। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে মানুষকে। আহত হচ্ছে অনেকে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে আহত হয়েছে বহু রোহিঙ্গা মুসলিম।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।