নবজাতকের মৃত্যু
অদক্ষতা নাকি অবহেলা?
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/10/28/photo-1509167609.jpg)
রাজশাহীর একটি সংবাদ সারা দেশে সাড়া ফেলেছে। সারাদেশে শুরু হয়েছে নানা রকম সমালোচনা। চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেছে- সিজারের সময় তিনি নবজাতকের মাথা কেটে ফেলেছেন। আর এতেই মৃত্যু ঘটেছে সেই নবজাতকের। তবে কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, শিশুটি জন্মের আগেই মারা গেছে।
কিন্তু নবজাতকের মাথায় কাটা যাওয়ার চিহ্ন স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। সেই কাটা অংশ থেকে রক্ত ঝরতেও দেখা গেছে। তাহলে শিশুটি যদি জন্মের আগেই মারা যায় তবে মাথা কাটা গেল কীভাবে। এর জন্য দায়ী চিকিৎসকের অদক্ষতা নাকি অবহেলা?
এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, চিকিৎিসকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ এটাই প্রথম নয়। সম্প্রতি চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুলজনিত কারণে রোগীর মৃত্যুর বেশ কিছু অভিযোগ বিভিন্ন মিডিয়ায় এসেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর অঙ্গহানি এমনকি মৃত্যুও ঘটছে। ভুল চিকিৎসা নির্ণয় খুবই জটিল, তা তদন্ত ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দাবি করে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের অবহেলা-অমনোযোগ একেবারেই স্পষ্ট। যেমন অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর দেহে কাঁচি, গজ, নিডল ইত্যাদি রেখে দেওয়ার ঘটনা এ দেশের হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে বারবারই ঘটছে। তা নিয়ে হাসপাতাল বা ক্লিনিক ভাঙচুর, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গোলযোগ, হাতাহাতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও নার্সদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়ার মতো সংবাদও আমরা দেখেছি এবং শুনেছি।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ সংক্রান্ত মামলার বেশির ভাগেরই নিষ্পত্তি হয় না। ফলে ভুক্তভোগীদের মধ্যে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া, অর্থাৎ চিকিৎসক বা চিকিৎসালয়ের ওপর চড়াও হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে অভিযুক্ত চিকিৎসকদের পক্ষে ধর্মঘটের মতো রোগীদের জিম্মি করা নানা কর্মসূচি গ্রহণের প্রবণতাও। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত গোটা চিকিৎসাসেবা খাত। ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসায় অবহেলা যেমন কাম্য নয়, তেমনি চিকিৎসকদের অহেতুক হয়রানির শিকার হওয়াও। দুটোই রোধ করা দরকার। এর জন্য অবশ্যই ভুল চিকিৎসা এবং চিকিৎসা অবহেলার বিষয়গুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করার জন্য আইনি ও প্রক্রিয়াগত ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রকৃত অপরাধীরা যাতে শাস্তি এড়াতে না পারেন, আবার অযথা যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হয়, দুটোই নিশ্চিত করতে হবে।
চিকিৎসা একটি মহৎ পেশা ও সেবাধর্মী যা মর্যাদাকর। এই মহৎ পেশায় যারা নিয়োজিত আছে বা হতে যাচ্ছে তাদের কাছে উচ্চ মানবিক মূল্যবোধ ও আচরণই প্রত্যাশিত। আমরা দেখছি রাজনৈতিক হানাহানি ও পেশিশক্তির চর্চা চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও জায়গা করে নিয়েছে। চিকিৎসরা নিজেরাই নানা দলাদলি ও হানাহানিতে লিপ্ত হচ্ছে, যার প্রকাশ প্রায়ই সাংঘর্ষিক রূপ নিচ্ছে। আমরা মনে করি, চিকিৎসাকেন্দ্রে কোনোরকম নৈরাজ্য ও দুর্বৃত্তপনা প্রশ্রয় পাওয়া উচিত নয়। আরো যেটা গুরুত্বপূর্ণ তাহলো চিকিৎসা পেশায় প্রবেশের ক্ষেত্রে মেধার পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধও যাচাইয়ের মানদণ্ড হওয়া উচিত।
ভুল যে কারো হতে পারে, চিকিৎসক আলাদা নন। সব ভুলের গুরুত্বও এক নয়। ভুল করে কাশির সিরাপ এক চামচ কম দেওয়া, আর ভুল করে ডান কিডনির বদলে বাম কিডনি কেটে ফেলা বা এক ওষুধের বদলে অন্য বা মারাত্মক ওষুধ দেওয়া এক নয়। কিছু ভুলের জন্য কোনো অজুহাতই গ্রহণযোগ্য নয়, এসব ক্ষেত্রে ডাক্তারের লাইসেন্স বাতিল করার বিধানসহ অন্যান্য শাস্তি দেওয়ারও নিয়ম আছে। কিন্তু এ কথাও আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ভুল বা অবহেলার যে অভিযোগ আনা হচ্ছে, তা অনেকাংশেই সত্য। এটাও ঠিক, ভুল আর অবহেলার ধারণা অনেক সময় অজ্ঞতার কারণেও হয়ে থাকে।
তাই কেউ মারা গেলে যদি ডাক্তারের অদক্ষতা বা অবহেলায় হয়ে থাকে, তবে প্রমাণ সাপেক্ষে অবশ্যই তার শাস্তি হওয়া উচিত।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন