নিরাপদ সড়ক
দুর্ঘটনার জন্য কি শুধু চালকই দায়ী?
সোমবার (৬ আগস্ট) মন্ত্রিসভায় সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় নামেন পরিবহন শ্রমিকরা। সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর তেজগাঁও রেলক্রসিং পার হয়ে ট্রাক স্ট্যান্ডে তাদের জটলা দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলে একজন বলেন, ‘ড্রাইভারের ফাঁসির আইন মানি না।’ বললাম, আইন তো এখনো হয়নি। আইন পাস হবে সংসদে। তিনি আমার ওপরে ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘আপনে কিছু জানেন না। শেখ হাসিনা বলছে, অ্যাকসিডেন্ট করলেই ফাঁসি।’ ওই শ্রমিককে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে নয় বুঝে তার সঙ্গে আর তর্ক না বাড়িয়ে সামনে পা বাড়াই।
বাস্তবতা হলো, গত ৪৭ বছর ধরে দেশের সড়কে যে নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলা চলছে, সেটি রাতারাতি একটি আইনের মাধ্যমে দূর করে ফেলার কথা ভাবাও বোকামি। তবে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিশু-কিশোররা দেশের ইতিহাসে যে অভূতপূর্ব আন্দোলন গড়ে তুলেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দীর্ঘদিন পরে হলেও এই ইস্যুতে যে একটি আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে, সেটিও কম কথা নয়। যদিও আইনের খসড়া আরো আগেই হয়েছে। কিন্তু এটি আলোর মুখ দেখছিল না। জনমতের চাপে পড়ে হলেও আইনটি এবার আলোর মুখ দেখছে এবং সংসদে গিয়ে এটি পাস হবে বলে আশা করা যায়। প্রশ্ন হলো, আইন হলেই সব সমস্যার সমাধান হবে কি না? তা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সব দায় কি চালকের একার?
পরিবহন শ্রমিকরা আইনটি সংসদে যাওয়ার আগেই এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন। তাদের যুক্তি হলো, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করতে হবে। এখানে শ্রমিকদের এটি বোঝানো দরকার যে খসড়া আইনে পরিষ্কার বলা হয়েছে, যদি চালকের বিরুদ্ধে কোনো যাত্রীকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়, কেবল তাহলেই ৩০২ ধারায় তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। তার মানে চালকের অসচেতনতা, অসাবধানতাও প্রধানত দায়ী হয়ে থাকে, তারপরও এটি প্রমাণিত হতে হবে যে চালক ইচ্ছে করে হত্যা করেছেন। কোনো গাড়ির চালক কি ইচ্ছে করে যাত্রীর গায়ে চাকা তুলে দেন?
রাস্তায় প্রতিদিন যে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে, তার সবকিছুর জন্য কি চালক একা দায়ী? বিআরটিএর ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যদি ত্রুটি থাকে, যদি তারা ঘুষের বিনিময়ে অদক্ষ লোককে লাইসেন্স দেয় এবং সেই ড্রাইভার যদি দুর্ঘটনার কারণ হন, তাহলে তার দায় কি বিআরটিএর নয়? কিন্তু খসড়া আইনে বিআরটিএকে অভিযুক্ত করা বা তার শাস্তির কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
এটি সর্বজন স্বীকৃত যে, দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা আর অনিয়মের পেছনে একটা বড় দায় ট্রাফিক পুলিশের। তারা যদি নিয়ম ও আইন প্রয়োগে সৎ ও আন্তরিক হয়, তাহলে দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু খসড়া আইনে অসৎ পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়ী করার কোনো বিধান নেই। পুরো আইনটি পড়লে মনেই হবে, দেশের সমস্ত সড়ক দুর্ঘটনার জন্য কেবল চালকরাই দায়ী।
রাস্তার ত্রুটি, ত্রুটিপূর্ণ এবং অপ্রয়োজনীয় স্পিডব্রেকার, সড়কে বিপজ্জনক বাঁক ইত্যাদি কারণেও প্রচুর দুর্ঘটনা হয়। তার জন্য চালকের দায় কতটুকু আর রাস্তার এসব ত্রুটি দূর করায় যাদের দায়িত্ব, তাদের দায় কতটুকু? কিন্তু খসড়া আইনে তো এ কথা বলা নেই যে, রাস্তার কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে সড়ক ও জনপথ বিভাগ বা স্থানীয় সরকার বিভাগকে এর দায় নিতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে একটা বড় কারণ মালিকদের অতি মুনাফার লোভ। আবার মালিকদের অতি মুনাফা করতে হয় প্রতিদিন রাস্তাঘাটে বিভিন্ন হাতে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয় বলে। বলাই হয়, পরিবহন খাত হচ্ছে চাঁদাবাজির সবচেয়ে বড় জায়গা। সুতরাং যে খাত থেকে সবচেয়ে বেশি চাঁদা আদায় করা হয় এবং যে চাঁদার ভাগ ক্ষমতাবানদের কাছেই যায়, সেই খাতের নৈরাজ্য শুধু একটি আইন দিয়ে দূর করা যাবে—এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই।
বলা হয়, পরিবহন শ্রমিকরা অশিক্ষিত, তাদের মানবিক মূল্যবোধ নেই, তারা জানে না একজন নারী বা বৃদ্ধ অথবা শিশুযাত্রীর সঙ্গে কী আচরণ করতে হবে। প্রশ্ন হলো, একজন পরিবহন শ্রমিককে বা আরো পরিষ্কার করে বললে একজন লোকাল বাসের চালক, হেলপার বা কন্ডাক্টরকে মালিক কয় টাকা বেতন দেন? তারা টাকার অঙ্কের যে মাইনে পান, তা অত্যন্ত অসম্মানজনক। সুতরাং এত কম পারিশ্রমিকে শিক্ষিত এবং মানিবক মূল্যবোধসম্পন্ন উন্নত রুচির লোক চাকরি করতে আসবেন কেন? আবার এই শ্রমিকদের বেতন যেহেতু কম, সুতরাং তারা সব সময়ই বাড়তি ট্রিপ দিয়ে উপরি আয়ের চিন্তায় থাকেন। মালিকের জন্য নির্ধারিত টাকা আয়ের পরে তারা বাড়তি আয়ের চেষ্টা করেন এবং তখনই প্রতিদ্বন্দ্বী বাসের সঙ্গে পাল্লায় দেন। বেপরোয়াভাবে চালান। সুতরাং এখানে দোষটা শুধু চালকের একার নয়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট বা এ রকম দূরপাল্লার অভিজাত বাসের চালকরা শিক্ষিত। তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। এসব বাসের হেলপার বা কন্ডাক্টরদের বিরুদ্ধে খুব বেশি খারাপ আচরণের অভিযোগ পাওয়া যায় না। কারণ তাদের বেতন ভালো। আবার এসব বড় পরিবহন তুলনামূলকভাবে পেশাদারিত্ব মনোভাব নিয়ে রাস্তায় চলাচল করে। যা লোকাল বাসের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
পরিবহন শ্রমিকদের কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে বলে মনে হয় না। কখনো সখনো বিশেষ করে ঈদের সময় দূরপাল্লার বাসচালকদের একটানা ১৪-১৫ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে হয়। মহাসড়কে গাড়ি চালানো এমনিতেই বেশ কষ্টের। বেশ ধৈর্য আর প্রতিমুহূর্তে চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হয়। কিন্তু একজন লোক যদি টানা ১৪-১৫ ঘণ্টা এভাবে গাড়ি চালান, তার তো স্নায়ু অবশ হয়ে যাওয়ার কথা। তার তো বেখেয়াল হওয়ারই কথা। সুতরাং তিনি যদি কোনো দুর্ঘটনায় পড়েন, তার দায় কার?
প্রধানমন্ত্রী এর আগেও বলেছেন, দূরপাল্লার বাসচালকরা একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাবেন না। প্রতিটি বাসে দুজন ড্রাইভার থাকবেন এবং তারা পাঁচ ঘণ্টা পরপর স্টিয়ারিংয়ে বসবেন। কিন্তু কোনো পরিবহন কোম্পানি কি এই কথা শুনেছে? যদি না শোনে, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য কেবল চালকদের দায়ী করা হবে কেন?
সারা দেশের মহাসড়কে প্রচুর অবৈধ যানবাহন, যেমন নছিমন-করিমন, ভটভটি, ভ্যান ইত্যাদি চলে। আবার প্রচুর মেয়াদোত্তীর্ণ এবং আনফিট গাড়িও চলে। এসব কারণে যদি সড়ক দুর্ঘটনা হয়, তার জন্য দায় কার?
এসব কারণে খসড়া আইনের নাম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে, এর নাম সড়ক পরিবহন আইন নয়, বরং হওয়া উচিত সড়ক পরিবহন ও সড়ক নিরাপত্তা আইন এবং এখানে শুধু এককভাবে চালককে দায়ী না করে সড়কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ, যেমন : মালিক, বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশ এমনকি অসেচতন যাত্রীদের জন্যও যেহেতু অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে, সুতরাং তাদেরও এই আইনের আওতায় আনা জরুরি।
আইনের খসড়াটি কেবল মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। এটি এখন সংসদে যাবে। সেটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। সংসদ সদস্যরা প্রতিটি ধারা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ পাবেন। সংশোধনী আনারও সুযোগ আছে। শুধু যে বিরোধী দলের এমপিরাই সংশোধনী দিতে পারেন তা নয়, বরং সরকারি দলের এমপিরাও যেকোনো আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর প্রস্তাব করতে পারেন। তাতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কোনো বাধা নয়।
লেখক : সাংবাদিক।