আন্তর্জাতিক
নেপাল-ভারত সম্পর্কের টানাপড়েনের নেপথ্যে
নেপাল-ভারত সম্পর্কের যে টানাপড়েন চলছে তার মূল কারণ নেপালের নতুন সংবিধান। রাজতন্ত্র পতনের পর দীর্ঘ নয় বছর ধরে সংবিধান দ্বারাই চলছিল নেপাল। কিন্তু এই সংবিধানের প্রত্যাশার ব্যাপ্তি ঘটেছে ৬৫ বছর ধরে।
১৯৪৯ সালে নেপালি কংগ্রেস রানা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় দলের ইস্তেহারে সংবিধান পরিষদ দ্বারা সংবিধান প্রণয়নের দাবি তোলে। ১৯৫১ সালে রানা রাজতন্ত্রের পতন এবং নেপালে গণতন্ত্রায়নের পথ সুগমে সমর্থন জানায় ভারত। সংবিধান প্রণয়নের দাবির ব্যাপারেও তাদের সমর্থন ছিল। তবে নেপালকে এই সংবিধানের স্বপ্ন পূরণে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০১২ সালে নেপালের প্রথম সংবিধান পরিষদ জনপ্রিয় সংবিধান প্রণয়নের পথে অগ্রসর হয়। কিন্তু সেই সময় প্রধান বিরোধী দল নেপালি কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনাইটড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট) চায়নি ক্ষমতাসীন নেপালি মাওবাদীরা এই সংবিধান প্রণয়ন করুক। তাদের সমর্থনের অভাবে এবং ভারতীয় চাপে মাওবাদীরা সংবিধান প্রণয়ন করতে পারেনি। নেপালি কংগ্রেস এবং সিপিএন(ইউএমএল) নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে ২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসে। তারাই শেষ পর্যন্ত মাওবাদীদের বিষয়সূচি অনুসরণ না করে সংবিধান প্রণয়ন করল।
নেপালের নয়া সংবিধান বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংসদীয় গণতন্ত্র এবং প্রজাতন্ত্রবাদের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এই সংবিধান প্রণয়নে সবচেয়ে বেজার হয়েছে মদেশি এবং থারু সম্প্রদায়। তারা বিহার এবং উত্তর প্রদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার অধিবাসী। তারা ভারত-নেপালের বাণিজ্য সীমান্ত অবরোধ করেছে। নেপালের একটি জনগোষ্ঠীর নাম মদেশ। ভারতীয়-বংশোদ্ভূত এই জাতিগোষ্ঠীর ওপর ভারতীয় প্রভাব যথেষ্ট। অনেক সংকটের সময় নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক প্রভাব খাটানোর প্রশ্নে সুকৌশলে ভারত, নেপাল সীমান্তবর্তী এই জনগোষ্ঠীকে কাজেও লাগিয়েছে। অতীতে নেপাল থেকে ব্যবসাবাণিজ্য করতে আসা মানুষ অনেক সময়ই ভারতীয় মহিলাদের বিয়ে করে সংসার পাতত। তাদের সন্তানরা বিভিন্ন সময়ে ফিরে গেছে নেপালে। বসবাস করেছে সীমান্তের কাছের তরাই অঞ্চলে। এই গোষ্ঠী থেকেই মদেশীয় সম্প্রদায়ের জন্ম।
নেপালের নয়া সংবিধান তৈরির সময় কিছু নির্দিষ্ট দাবি তুলেছিলেন মদেশীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা দাবি করেছিল, মদেশীয় সম্প্রদায়ের জন্য আটটি জেলা নির্দিষ্ট করা হোক। কিন্তু বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি সংবিধানে। শুধু বলা হয়েছে একটি কমিশন গঠন করে, পরে এই বিষয়ে মীমাংসা করা হবে। নেপালের পার্লামেন্টে তাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরো একটি বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে নেপালের গণ পরিষদ। নয়া সংবিধান অনুযায়ী, কোনো নেপালি নারী বিদেশি পুরুষকে বিয়ে করলে সন্তানকে নতুন সংবিধান অনুযায়ী নেপালের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না, যতক্ষণ না সেই ভিনদেশি পুরুষটি নেপালের নাগরিকত্ব নিচ্ছে।মদেশীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের মতে, যেহেতু তারা সীমান্ত অঞ্চলে বসবাস করে, তাদের ভারতীয়দের সঙ্গে প্রণয়বদ্ধ হওয়ার ঘটনাও প্রায়ই ঘটে। সে ক্ষেত্রে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নেপালের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করে প্রান্তিক করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে নতুন সংবিধানে। পরিণতিতে এই অবরোধ।
নেপালের জনসংখ্যার শতকরা ৩০ ভাগ মদেশি। তাদের একটি কৌশলগত গুরত্ব রয়েছে। তারা যে অঞ্চলের অধিবাসী সে অঞ্চলটি নেপালের শস্যাগার বলে পরিচিত এবং ওই অঞ্চলে নেপালের অনেক শিল্প-কারখানা অবস্থিত। তাদের স্বাধিকারের সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৯৯ সালে রাজা বীরেন্দ্র যখন বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন করেন। তারা আরো সঞ্জীবনি শক্তি পেল যখন মাওবাদীরা ১০ বছরব্যাপী জনযুদ্ধের সময় প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জন্য স্বশাসনের প্রতিশ্রুতি দিল।
সংবিধান প্রণয়ন যখন চূড়ান্ত তখন মদেশি নেতারা নিজেদের সংখ্যালঘু হিসেবে মনে করল। তাদের বেশির ভাগই সংবিধান সভা ত্যাগ করেছিল। কিন্তু তিনটি বৃহৎ দলের মদেশি নেতারা কিন্তু নতুন সংবিধানের জন্য ভোট দিয়েছিল। এমনকি দেশটির রাষ্ট্রপতি রামবরণ যাদব নিজেই মদেশি।
নেপাল যেন হিন্দু রাষ্ট্র থাকে তা ভারতের বিজেপি নেতাদের প্রত্যাশা ছিল। তারা নয়া সংবিধানের ধর্মনিরেপক্ষতাকে মানতে পারছে না। আর বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারই তো ভারতের ক্ষমতায়। তাই মোদী সরকারের মনোভাব একই। সাথে মদেশীপ্রীতি তো রয়েছেই। বিশেষ করে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের নেপালী নেতাদের সাথে আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে ভারত নেপালের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে।
এদিকে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে নেপালের ওপর অঘোষিত অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে রেখেছে ভারত। জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের জন্য ভারতের ওপর নেপাল ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। অথচ কোনো পণ্য নেপালে ঢুকতে পারছে না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, বিক্ষোভের কারণে তারা নেপালে পণ্য পাঠাতে পারছে না। কিন্তু যেসব সীমান্তে কোনো ধরনের বিক্ষোভ নেই, সেখান দিয়েও কেন পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে না, সে প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়নি। নেপাল এই উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ফলে নেপাল পরিস্থিতির প্রভাব উপমহাদেশজুড়ে অনুভূত হতে পারে।
এর আগে ১৯৮৯ সালে ভারত নেপালের ওপর অবরোধ আরোপ করে। তখন নেপালের রাজা বীরেন্দ্র চীন থেকে অস্ত্র আমদানি করায় বেজায় চটেছিল রাজীব গান্ধী সরকার। কিন্তু ওই সময়ের সাথে এখনকার অনেক পার্থক্য রয়েছে। তখনকার অবরোধ ছিল একক রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। আর এখন সেখানে নির্বাচিত সরকার। ভারত যদি অবরোধ অব্যাহত রাখে তাহলে কী হবে? সাধারণ ধারণা হলো, নেপাল অনেক বেশি দুর্ভোগ পোহাবে। তবে আসলে সবশেষে তা ভারতের জন্যই বেশি ক্ষতিকর হবে। সীমান্ত বন্ধ করার পরিণাম ভারতের জন্যই যে হিতে বিপরীত হবে তার পাঁচটি কারণ এখানে তুলে ধরা হলো।
১. ভারতবিরোধী মনোভাব
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বছর নেপাল সফরে গিয়ে নেপালে ভারতবিরোধী মনোভাব দূর করতে সফল হয়েছিলেন। আর এ কারণেই ‘বাইলেটারাল ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন অ্যান্ড প্রটেকশন (বিআইপিপিএ)’ এবং ‘আপার কারনালি পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট (পিডিএ)’ বলতে গেলে কোনো ধরনের বিরোধিতা ছাড়াই স্বাক্ষরিত হতে পেরেছিল।
এই অবরোধ নেপালিদের একটি প্রজন্মকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। এর ফলে অবরোধ শেষ হওয়ার কয়েক বছর পরও নেপালের সাথে ব্যবসা করতে ভারতের কাঠখড় পোড়াতে হবে।
২. ভারতীয় বাজার
ভারত থেকে প্রতি বছর নেপাল ৫০০ কোটি রুপি মূল্যের পণ্য আমদানি করে। আর রপ্তানি করে ১০০ কোটি রুপিরও কম। অবরোধ যত চলতে থাকবে, তত বেশি নেপাল বাণিজ্যের জন্য চীনের দিকে ঝুঁকবে। ভারতের মতো বিশাল অর্থনীতির জন্য ৫০০ কোটি রুপি বেশি কিছু নয়, তবে ভারত অন্তত মুনাফা থেকে বঞ্চিত হবে।
৩. চীনা কার্ড
কাঠমান্ডুতে বেইজিংয়ের প্রভাব নিয়ে নয়া দিল্লি সব সময়ই উদ্বেগে থাকে। নেপালের সংবিধানকে স্বাগত না জানিয়ে এবং অবরোধের হুমকি দিয়ে ভারত চীনা প্রভাব ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেবে। নেপালে চীনের তেমন বড় ধরনের স্বার্থ নেই। তবে নয়া দিল্লির কাছ থেকে কাঠমান্ডুকে সরিয়ে নিতে পারাটা বেইজিংয়ের জন্য লাভজনক হবে।
৪. কম নির্ভরশীলতা
নেপাল ক্রমবর্ধমান হারে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল। কিন্তু অবরোধের ফলে নেপালিরা বিকল্প খুঁজবে, আরো বেশি আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে। এমনকি রাজনীতিবিদরা পর্যন্ত এই চিন্তা করা বন্ধ করে দেবেন যে, নয়া দিল্লির আশীর্বাদ ছাড়া শীর্ষ পদগুলোতে যাওয়া যাবে না।
৫. ভারতীয় নিরাপত্তা
যদি ভারত নিজেকে নেপালের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়, তবে পাকিস্তানের প্রভাবও বাড়বে। আবার ভারতের সাথে নেপালের খোলা সীমান্ত রয়েছে। কাঠমান্ডুতে ভারতবিরোধী মনোভাব ভারতের জন্য সুখকর হবে না।
নেপালে ভারতের অবরোধ সেখানকার জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি করছে। আজ সেখানকার প্রধান তিনটি দল ভারতবিরোধী মনোভাবে একাট্টা হয়েছে। ইতিমধ্যে সেখানে ভারতীয় চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ হয়েছে।
অনেক প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ হয়েছে। ভারতের ওপর নির্ভর নেপাল আজ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। এটি ভারতের জন্য অশনি সংকেত। আসলে ভারত তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ওপর প্রভুত্ব ফলাতে চায়। ভারতের বৃহৎ পুঁজির রয়েছে একটি আগ্রাসী চরিত্র। সেটা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর জন্য সুখকর নয়। ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপ শুধু নেপালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তা প্রযোজ্য বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভুটান , মালদ্বীপের ক্ষেত্রেও। আর পাকিস্তানের সাথে তো তার চির বৈরিতার সম্পর্ক। নেপাল প্রতিবাদী হয়ে আজ অন্য দেশগুলোকেও সাহস জোগাচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক।