মধ্যপ্রাচ্যে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথে?
ইসরাইল ও ইরানের বহু পুরোনো শত্রুতা,যা তীব্র আকার ধারণ করে এ বছরের ১৪ এপ্রিলে যখন ইরান সরাসরি ইসরাইলে হামলা চালায়। হামলার কারণ হিসেবে ইরানের দাবী গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরাইলি হামলায় ইসলামি বিপ্লবী বাহিনীর এক কর্মকর্তা নিহত হন। তার জবাবে অনেকটাই আগে থেকে জানিয়ে ইসরাইলে সাড়ে ৩০০ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান।
এতে দক্ষিণ ইসরাইলের একটি সামরিক ঘাঁটি সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই রেশ না কাটতেই মধ্যপ্রাচ্যে আবারো বেজে উঠছে যুদ্ধের দামামা। এরই মধ্যে ইসরাইল হিজবুল্লাহ দমনের নামে লেবাননে সর্বাত্মক হামলা চালাচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই হামলায় দুই হাজারের ও বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। হামলায় হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ ও নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের গুপ্ত ফেজার হামলায় ও সহস্রের ও বেশি হিজবুল্লাহ সেনা নিহত হন। লেবানন এবং গাজায় হামলার বন্ধ ও ইরানে গুপ্ত হামলা করে তাদের গুরুত্বপূর্ণ লোকদের হত্যার প্রতিবাদে গত ১ অক্টোবর ইসরায়েলে স্মরণকালের ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল ইরান। যেখানে বেশিরভাগই ক্ষেপণাস্ত্র ও মিসাইল লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত এনেছে বলে দাবি ইরানের যা ইসরায়েলের জন্য অশনী সংকেত। এই হামলার প্রতিশোধ নিতে ইরানে হামলা চালানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল ইসরায়েল।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ইরানে হামলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে ইসরায়েল। লেবানন ও গাজা উপত্যকায় হামলা চালানোর পাশাপাশি ইরানে এই হামলা চালানো হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে ইরানও ও হুশিয়ারি দিয়ে রেখেছো, ইরানে হামলা হলে পূর্বের হামলার চাইতে ভয়াবহ হামলা হবে ইসরাইলে। মধ্যেপ্রাচ্যে কি তাহলে সত্যিই আরেকটি যুদ্ধ বেধে যাবে? পুরো বিশ্ববাসীর মনে এই প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। আপাতদৃষ্টিতে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে এই যুদ্ধ পরিলক্ষিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ছড়িয়ে পড়বে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবগুলো দেশেই। ইসরাইল প্রাথমিকভাবে হামলার প্রতি উত্তরের ইরানের জ্বালানি তেলের মজুদ ও পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র সহ নানন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছে তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবজ সংকেত না মেলায় আপাতত সেই হামলায় যাচ্ছে না ইসরাইল।
তবে হামলার জবাবে পাল্টা হামলা চালাবে ইসরাইল তা অনেকটাই অনুমেয় এবং এই পাল্টা হামলার উপরে নির্ভর করবে মধ্যপ্রাচ্যে কি আরেকটি সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে এগোবে, নাকি হুমকি ও ছোট ছোট হামলা পর্যন্ত সীমিত থাকবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা বিশ্বগুলোও মধ্যেপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের বিপক্ষে। কারণ ইরানে হামলা হলে, ইরান তার নিয়ন্ত্রিত হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেবে। যেখান দিয়ে বিশ্বের ৩০ শতাংশ জ্বালানী রপ্তানি হয়। যার ফলে জ্বালানি সংকটে পড়বে পুরো পশ্চিমা বিশ্ব। এদিকে সামনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নির্বাচন। সবকিছু মিলে পুরো বিশ্ব গভীর সংকটের মধ্যে পড়বে। এছাড়া ইরানে হামলা হলে ইরান তার সর্বাত্মকভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রের মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলোতেও হামলা হতে পারে। অন্যদিকে ইরানের প্রক্সি বাহিনী গুলো দিয়েও আরো তীব্র হামলা চালানো হতে পারে ইসরাইলে। ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ও ত্রুটি ধরা পড়েছে।
ইসরাইল যে আকাশ প্রতিরোক্ষ ব্যবস্থা নিয়ে এতদিন গর্ব করতো, তা ধুলোর সাথে মিশে গেছে, ইরানের ছড়া মিসাইল ও হিজবুল্লাহর ড্রোন হামলা ইসরাইলের একটি সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আঘাত হানে। সেখানে বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। যার ফলে আতঙ্কে রয়েছে সাধারণ ইসরাইলিরাও। গণমাধ্যমের খবর বলছে ইতোমধ্যেই লক্ষাধিক ইসরাইলি ইসরাইল ছেড়েছে।
তবে ইসরাইলিদের নিরাপওায় বরাবরের মতই যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত ও সর্বাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থার্ড ও রক্ষাণাবেক্ষনের জন্য ১০০ সৈন্য পাঠিয়েছে। তবে ইসরাইলের পশ্চিমা মিত্রদের কার্যকলাপের দিকে নজর দিলেও যুদ্ধের সম্পর্কে কিছুটা ভবিষ্যৎবাণী করা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের পুরাতন অস্ত্র ইরানের উপর প্রয়োগ করেছে। তারা ইরানের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইসরাইলের মিত্র রাষ্ট্রগুলো এই মুহূর্তে বড় সংঘাত এড়াতে চাইছেন, না হয় ইসরাইলের প্রতি উত্তর দিতে এত দিন অপেক্ষা করবার কথা নয়। এটা ঠিক ইরানের উপর ইসরাইলে একা হামলা করার সাহস ও সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে জয় নিয়ে ফিরে যারার সম্ভবনা খুবই কম তাই ইসরাইল তার পশ্চিমা মিত্রদের সাথে নিয়েই হামলা চালাবে।
এদিকে আঞ্চলিক দিক বিবেচনা করলে মধ্যপ্রাচ্য ইরান এখন একক ক্ষমতাধর শক্তিতে রুপান্তর হচ্ছে। দীর্ঘ দিনের বৈরি সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছ। ইতোমধ্যে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো ইরানের তেল স্থাপনায় হামলা করা থেকে ইসরায়েলকে বিরত রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে । তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, যদি সংঘর্ষ বাড়তে থাকে তাহলে দেশগুলোর নিজস্ব তেল স্থাপনাগুলো হামলা চলাতে পারে ইরানের প্রক্সিগ্রুপগুলো। তিনটি উপসাগরীয় সূত্রে বরাতে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। সংস্থাটি বলছে, এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতারসহ উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো ইরানের আক্রমণের জন্য ইসরায়েলকে তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে দেবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে। সেদিক থেকে এদেশ গুলো হয়তো আগের মত ইসরাইলে অন্ধভাবে সমর্থন করা থেকে বিরত থাকবে যা ইরানের জন্য স্বস্তিদায়ক। অন্যদিকে আরেক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র রাশিয়ার সাথে ও জরুরি বৈঠক সেরেছে ইরান। ১১ অক্টোবর তুর্কমেনিস্তানের রাজধানীতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের মধ্যে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো এগিয়ে নেয়ার আশা প্রকাশ করা হয়। ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধে ইরান যেভাবে ড্রোন দিয়ে রাশিয়াকে সহায়তা করেছে তাই ধারণা করা যায় রাশিয়া হয়তো বা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির বাকি কাজে সহায়তা করছে এবং নতুন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করবে। এত জটিল সমীকরণ উপেক্ষা করে ও যদি ইসরাইল একগুঁয়েমি ভাবে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ঠিকে গেলে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিকে এ অঞ্চল থেকে বিদায় নিতে হবে। কেননা ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন সহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে ইরানের প্রক্সি গ্রুপ ব্যপকহারে হামলা চালাবে। সাথে রাশিয়া চীন চাইবে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে থেকে পিছু হঠা।এ সুযোগে নতুন করে রাশিয়া ও চীন এ অঞ্চলে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। আর সম্মুখ যুদ্ধে ইরানের সাথে ইসরাইল কখনই পেরে উঠবে না। সেক্ষেত্রে বিমান হামলা বা ক্ষেপনাস্ত্র হামলাই একমাত্র ভরসা ইসরাইলের। আর এ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা তীব্র হলে ইরান তার পাল্টা জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটি ও ইসরাইলে হামলা করবে। তাই যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না মধ্যপ্রাচ্য তাদের কর্তৃত্ব শেষ হয়ে যাক। তারা ইরানকে চাপের মুখে রাখবে। ইরানের হামলার প্রতিবাদে ইসরাইল ইরানের সামরিক স্থাপনায় সীমিত আকারে হামলা চালাবে এবং টার্গেটেড কিছু গুপ্ত হামলা চালাবে, যেটাতে ইসরাইল খুব পারদর্শী।
যার ফলশ্রুতিতে হামাসের নতুন প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করা হয়েছে বলে ইসরাইলের দাবি। ইসরাইলের এত বড় আকারের যুদ্ধ একা পরিচালনা করার শক্তি ও সামর্থ্য নেই। অন্যদিকে ফিলিস্তিনে গণহত্যায় অনেক পশ্চিমা রাষ্ট্রও ইসরাইল থেকে নিজেদের সমর্থন সরিয়ে নিয়েছেন। তাই ধারণা করা যায়, খুব বড়ো আকারে যুদ্ধ হয়তো এ যাত্রায় বাধবে না। তবে দিনে দিনে মধ্যপ্রাচ্যে এক জীবন্ত বোমায় পরিণত হচ্ছে যা যে কোন মুহূর্তে বিস্ফোরিত হবে।
লেখক : প্রভাষক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।