আন্তজার্তিক
বিজেপির জয়, কংগ্রেসের পরাজয়ের সহজ সমীকরণ
ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘদিনের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটলেও জয়-পরাজয়ের সমীকরণটা রয়েই গেছে। আগেরবারের চেয়ে আরো বেশি আসনে জয় পেয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছে বিজেপি জোট। এবারের নির্বাচনে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি করলেও শেষ পর্যন্ত টালমাটাল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট। ভারতে বিজেপি এবং কংগ্রেস ছাড়া সর্বভারতীয় কোনো দল নেই। দেশজুড়ে সংগঠন-সমর্থক আছে এই দুই দলেরই। তবে ভারতে এখন চলছে আঞ্চলিক দলের জয়জয়কার। একেক রাজ্যে একেক দল ক্ষমতায়। এই আঞ্চলিক দলের নেতারা কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে নিজের অবস্থান জানান দিতে চান। তারা কেন্দ্রে সরকার গঠনের স্বপ্নও দেখে। কিন্তু তারা আবার সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন না। ভারতে এখন মোটা দাগে তিন ধারার রাজনীতি চলছে।
এক ধারার নেতৃত্বে বিজেপি। এরা মূলত সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্ববাদী। আরেক ধারার নেতৃত্বে কংগ্রেস। এরা অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষে। এর বাইরে আর সবাই। এদের অবস্থান কিছুটা জগাখিচুরির মতো। অসাম্প্রাদায়িক-সাম্প্রদায়িক মিলেমিশে একাকার। একসময়ে ভারতে বামপন্থি একটি ধারা প্রবল হয়ে উঠছিল। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা এবং ত্রিপুরায় দীর্ঘদিন সরকারে ছিল কমিউনিস্টরা। এখন এই কমিউনিস্ট বিলীনপ্রায়। তারা নানা দলে গিয়ে মিশেছে, এমনকি বিজেপিতেও।
বিজেপিবিরোধী একটি বৃহত্তর মোর্চা যদি এবারের নির্বাচনের আগে থেকে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারত তাহলে হয়তো ভোটারদের মধ্যে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। কিন্তু সেটা হয়নি। তাই নির্বাচনে আগেরবারও যেমন মোদি ছিলেন দাপটের সঙ্গে, এবারও তার খুববেশি হেরফের হয়নি। হিন্দি বলয়ে বিজেপি এবার খুব খারাপ করবে বলে মনে করা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। লোকসভা নির্বাচনে অনেকেই মনে করেছিলেন তরুণ নেতা হিসেবে রাহুল গান্ধী নিজেকে মোদির চেয়ে বড় নেতা হিসেবে তুলে ধরতে পারবেন। কিন্তু ভারতের জনগণের মধ্যে তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিকল্প হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। জনগণের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছেন নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও। ফলে এবার ভরাডুবি হলো এই জোটটির।
ভারতের জনগণ বিভিন্ন কারণেই মোদির চেয়ে আর কাউকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যোগ্য বলে ভাবেনি। কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী মোদির প্রধান প্রতিপক্ষ। কিন্তু মানুষের কাছে তার ইমেজ ততটা বাড়েনি। ভোটের আগে বোন প্রিয়াঙ্কাকে সঙ্গে নিয়েও তেমন সুফল পাওয়ার অবস্থা তৈরি করতে পারেনি। এবার গোটা ভারতের রাজনীতিতে সরকারবিরোধী বেশ কিছু ইস্যু থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস জোট সুবিধা করতে না পারায় রাজনীতির সমীকরণ পাল্টে গেছে। ১৫ লাখ চাকরির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ ছিল। ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগান ছিল। নোটবন্দি, জিএসটি থেকে বিজয় মাল্য, নীরব মোদি ইস্যুতেতে মোদিবিরোধী হাওয়া তুলতে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। ‘ন্যায়’ প্রকল্পের ঘোষণা হয়েছিল। ময়দানে নেমেছিলেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। কিন্তু কোনো কিছুই কাজে এলো না। নরেন্দ্র মোদির বিকল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেন না রাহুল গান্ধী। ভরাডুবি কংগ্রেসের। প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগান ব্যুমেরাং হয়ে ফিরল কংগ্রেসের হাতে?
সপ্তদশ লোকসভা ভোটের ইভিএম খুলতেই দিকে দিকে বিজেপির জয়ধ্বনি। কয়েক মাস আগেই হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্য, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগড়, রাজস্থানে বিজেপিকে হারিয়ে প্রায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেস। কিন্তু সেই সব রাজ্যেও লোকসভায় শোচনীয় ফল কংগ্রেসের। কেন? রাজনৈতিক শিবিরের মতে, বিধানসভা ভোট এবং লোকসভা ভোট হয় আলাদা সমীকরণে। আমজনতার চাওয়া-পাওয়া থেকে নেতাদের প্রতিশ্রুতি, সবই আলাদা হয়। এই তিন রাজ্যের ভোটাররা সেই পরিণত মস্তিষ্কের সাক্ষ্যই রেখেছেন লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটে আলাদা আলাদা রায় দিয়ে। ধারণা করা যায়, এই তিন রাজ্যে কংগ্রেসের জয় এসেছিল আঞ্চলিক রাজনৈতিক সমীকরণ মেনে এবং দীর্ঘ দিনের বিজেপি শাসনে মানুষের বীতশ্রদ্ধ হওয়ার প্রতিফলন। রাহুল ফ্যাক্টর সেখানে কাজ করেছে খুব সামান্যই।
এ ছাড়া কংগ্রেসের ঋণাত্মক প্রচারও তাদের পরাজয়ের কারণ। ক্ষমতায় এলে কী করবেন, সেটার থেকেও রাহুল গান্ধীর প্রচারে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মোদি বিরোধিতা। ‘ন্যায়’ প্রকল্পে গরিব কৃষকদের বছরে ৭২ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তা ছাড়া সেভাবে কোনো ইতিবাচক বার্তা ছিল না রাহুলের প্রচারে। অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো ক্ষেত্রে উন্নয়ন করতে কংগ্রেসের রোড ম্যাপ কারও কাছেই স্পষ্ট হয়নি। বরং মোদি জমানায় কী কী দুর্নীতি হয়েছে, কীভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের চেষ্টা হয়েছে, নোটবন্দি-জিএসটিতে কী ক্ষতি হয়েছে, সে সবের কোনো দিশা ছিল না রাহুল তথা কংগ্রেসের প্রচারে। শুধু গোঁয়ার্তুমির মতো মোদি সরকারকে সরাতে হবে, এটাই ছিল কংগ্রেসের লক্ষ্য। কিন্তু তাকে সরিয়ে বিকল্প কে আসবেন এবং তারা দেশবাসীকে কী দেবেন, তার কোনো রূপরেখা তৈরি হয়নি। ফলে মানুষের কাছে আস্থা অর্জন করতে পারেননি রাহুল।
উল্টো দিক থেকে ভাবলে, এই সব জায়গাতেই এগিয়ে গেছে বিজেপি। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ, শৌচালয়, রান্নার গ্যাসের মতো সরকারি প্রকল্পের সাফল্য তুলে ধরে উন্নয়নের খতিয়ান এবং ক্ষমতায় এলে আরো উন্নয়নের স্বপ্ন ফেরি করেছেন মোদি। তার সঙ্গে জুড়েছেন উগ্র জাতীয়তাবাদ আর দেশাত্মবোধের হাওয়া। মোক্ষম সময়ে হাতে পেয়ে গেছেন বালাকোটে বায়ুসেনার অভিযান, অভিনন্দন বর্তমানের ডগ ফাইটের মতো ইস্যু। অথচ এই দেশাত্মবোধের হাওয়ার বিরুদ্ধে জবাব দেওয়ার মতো জুতসই কোনো ব্যাখ্যা বা জবাব দিতে পারেনি রাহুলের নেতৃত্বে কংগ্রেস।
নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতে ধারণা করা হচ্ছিল, পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে মোদি তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন, তাই তার এবারের লড়াই জয় সহজ হবে না। নির্বাচন কয়েক দফা হওয়ার পর বলা হচ্ছিল মোদির কপালে নাকি ভাঁজ পড়ে গেছে। অর্থাৎ তার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। বিরোধী মহলে এক ধরনের উল্লাস লক্ষ করা যাচ্ছিল। অবশ্য নিজেদের জয়ের ব্যাপারে মোদি বরাবরই ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোদিতে আস্থা হয়তো কিছুটা কমেছে কিন্তু বিরোধীদের প্রতি আস্থাটা ততটা বাড়েনি। সংসদ নির্বাচনটা ভারতবাসী এবার সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন হিসেবে নিয়েছিল। ফলে মোদির বিপরীত কোনো নেতাকে ভারতবাসী পছন্দের শীর্ষে তুলতে পারেনি। কাজেই ‘মোদি বনাম অন্যরা’ এই লড়াইয়ে মোদিই টিকে রইল।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।