১৭ বছরে এনটিভি
এনটিভি সময়ের সাথে আগামীর পথ দেখায়
‘দর্শক খায়’—কথাটি টেলিভিশনে খুব চাউর, বিশেষ করে যখন কোনো অনুষ্ঠানের মান বা সেই অনুষ্ঠানের নীতিনৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন অনেকেই এর পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, ‘দর্শক এটা খায়।’
এখন কথা হচ্ছে, গণমাধ্যমের দায়িত্ব কি শুধু এই যে সে শুধু দর্শক যা খাবে, সেটিই প্রচার করবে নাকি জনরুচি তৈরি করা এবং রুচিহীন অনুষ্ঠান নির্মাণ ও প্রচার না করাও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? কেননা, সেই টেলিভিশন যখন বাসার সবচেয়ে প্রবীণ মানুষটি থেকে শুরু করে অবুঝ শিশুও দেখে। এ কারণে গৃহকর্মীর বিনোদনের কথাও টেলিভিশনকে মাথায় রাখতে হয়। ফলে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বহুবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সেখানে পেশাদারিত্ব এবং তার বাণিজ্যিকভাবে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ যেমন আছে, তেমনি মানসম্মত অনুষ্ঠান এবং নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টাটাই বা কয়টি টেলিভিশন করছে বা করতে পারছে?
এ কথা মেনে নিতে কার্পণ্য করা উচিত হবে না, যে কয়টি টেলিভিশন শুরু থেকে এই জনরুচি তৈরি তথা সব শ্রেণির দর্শকের কথা মাথায় রেখে মানসম্মত বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি গ্রহণযোগ্য সংবাদ ও সংবাদভিত্তিক টক শো বা আলোচনা অনুষ্ঠান নির্মাণের চেষ্টা করছে, এনটিভি তাদের অন্যতম, কখনো শীর্ষে বললেও অত্যুক্তি হবে না।
বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশনের যাত্রা শুরু ১৯৯৭ সালে। ওই বছরের ১৫ জুলাই সম্প্রচারে আসে এটিএন বাংলা। এর দুই বছর পরে আসে চ্যানেল আই। ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে একুশে টেলিভিশন। বস্তুত বিটিভিনির্ভর দর্শকদের প্রথম টেলিভিশন সংবাদের ভিন্ন স্বাদ এনে দেয় এই একুশে টেলিভিশন এবং এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেওয়া উচিত যে, টিভি সাংবাদিকতাও যে একটি বড় পেশা এবং সাংবাদিকরাও যে তারকা হতে পারেন, সেই ধারণাটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত করে একুশে টেলিভিশন বা ইটিভি।
এর তিন বছর পরে ২০০৩ সালের ৩ জুলাই আনুষ্ঠানিক সম্প্রচারে আসে এনটিভি এবং শুরু থেকেই দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণে রুচিসম্মত নাটক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদে একটা ভিন্ন আবেদন তৈরি করে এই টেলিভিশন চ্যানেল।
যে স্লোগান নিয়ে এনটিভি যাত্রা শুরু করে ‘সময়ের সাথে আগামীর পথে’—সেটিই এর শক্তি। কেননা, গণমাধ্যমের কাজই হলো সময়ের সাথে থাকা এবং মানুষকে আগামীর পথ দেখানো। সময়ের সাথে থাকা মানে বর্তমান সময়ের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলা। সাদার ওপরে বাড়তি রং চড়িয়ে অর্ধসত্যকে সত্য কিংবা মিথ্যায় পরিণত করা গণমাধ্যমের কাজ নয়।
আবার বিনোদনের নামে একই জিনিস ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রং বদলে, একই ঘটনাকে উপস্থাপনের কায়দা পাল্টে, ক্লীশে গল্প ও সংলাপ দিয়ে মানুষকে সুড়সুড়ি দিয়ে, কিছু আঞ্চলিকতা, কিছু ভাঁড়ামোর সমন্বয়ে এখন টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যেসব নাটক বানাচ্ছে, সেই গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসানোর একটা সুনাম এনটিভির আছে।
এনটিভির নাটক শুরু থেকেই জনপ্রিয় ছিল এবং এখনো রুচিশীল, ভালো গল্প, নৈতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ বিষয়গুলো মাথায় রেখে এ নাটক নির্মাণের যে চেষ্টা করছে, সেখানে বাণিজ্যিক সফলতাও আছে। সুতরাং ‘দর্শক খায়’ বলেই যা খুশি চালিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা অনেক টেলিভিশন করছে, সেখানে মূলত তাদের চিন্তার দীনতা, আইডিয়ার সংকট এবং রুচির অভাববোধকেই দায়ী করা ভালো। দর্শক সবকিছু খায় না। বরং দর্শকের সামনে আপনি কী দিচ্ছেন, সেটি নির্ভর করে আপনার নিজের রুচিটা কেমন। সেই বিবেচনায় এনটিভি এখন পর্যন্ত যেসব অনুষ্ঠান নির্মাণ করছে, সেগুলো বহু বছর ধরেই একটা মান ধরে রেখেছে, সাথে সাথে দর্শকও এগুলো খাচ্ছে। প্রসঙ্গত শুভ সন্ধ্যা, এই সময়, ফ্রাঙ্কলি স্পিকিংয়ের মতো অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা যায়।
টেলিভিশনের স্ক্রিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যত ভালো, চিন্তাশীল বা রুচিশীল অনুষ্ঠানই নির্মাণ করা হোক না কেন, টেলিভিশনের স্ক্রিন পরিচ্ছন্ন এবং তার রংটি চোখের জন্য আরামদায়ক না হলে দর্শককে টানে না। এই জায়গায় এনটিভি শুরু থেকেই তার স্ক্রিন ও রঙের ব্যাপারে আন্তরিক। তার স্ক্রিন স্বচ্ছ এবং সবুজের প্রাধান্য থাকায় সেটি চোখের জন্য আরামদায়ক। এনটিভির শব্দ বা সাউন্ড কোয়ালিটিও যথেষ্ট ভালো। ফলে ভালো কনটেন্টের পাশাপাশি স্ক্রিনের স্বচ্ছতা, রং ও শব্দও এনটিভিকে অন্য যেকোনো চ্যানেলের চেয়ে এগিয়ে রাখে। অর্থাৎ সময়ের সাথে সাথে দর্শককে আগামীর পথ দেখাতে গেলে আগে নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে, সেই প্রস্তুতিটা এনটিভির আছে বলেই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এ রকম একটি লেখার তাগিদ অনুভব করলাম—তার প্রতিদ্বন্দ্বী একটি টেলিভিশন চ্যানেলের কর্মী হয়েও।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।