জেলহত্যা দিবস
ইতিহাসের আরেকটি ঘৃণ্য অধ্যায়
নভেম্বর মাসের ৩ তারিখ ভোরবেলায় কে ধারণা করেছিল যে, সেদিনও জাতিকে আরেকটি ১৫ আগস্ট দেখতে হবে? ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির জনককে যেভাবে নির্বংশ করার জন্য সপরিবারে হত্যা করেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় এবং সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পৃথিবীর ঘৃণ্য ও জঘন্যতম জেলহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। ঠিক তেমনি বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এটি যত সহজে বলা যাচ্ছে, মোটেও তত সহজ বিষয় নয়। আর আমার মতো একজন সাধারণ নাগরিক বিষয়টি যেভাবে বলছি, রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে তা কোনোভাবেই এত সহজে বলা সম্ভব নয়।
আমাদের এই বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস দীর্ঘদিনের তথা কাল-কালান্তরের। সকল কাল-অকালকে পেছনে ফেলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের সবার প্রিয় এই সোনার বাংলা স্বাধীন হয়েছে। সেই সোনার বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য কোনো ম্যাজিক বাক্স ছিল না। বাঙালিকে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে তা অর্জন করতে হয়েছে। বাঙালি আসলে একটি বীরের জাতি। এখানে ঘরে ঘরে বীরসন্তানরা বসবাস করেন। সে জন্যই বীর বাঙালিদের মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ একটি দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করা যে কত কঠিন, তা মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছে। স্বাধীনতা এবং যেখানেই বাঙালির স্বাধিকারের বিষয়টি আসে, সেখানেই সুদীর্ঘ একটি ইতিহাসের অবতারণা করতে হয়। সেখানে ছিল পাকিস্তান-ভারত উপমহাদেশ তথা ভারতবর্ষের সুদীর্ঘ ইতিহাস। সেই বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধের মহানায়ক ছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেসব যুদ্ধের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে অনুঘটক ও সংগঠক হিসেবে যেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অগ্রজ রাজনীতিক শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো নেতৃবৃন্দ, যাদের বঙ্গবন্ধু দেশের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের জন্য একসময় খুবই ভরসা করতেন। তেমনি তাঁরাও বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নিবেদিতপ্রাণ নির্লোভ রাজনৈতিক সংগঠককে সহকর্মী হিসেবে পেয়ে আশ্বস্ত বোধ করতেন।
শেখ মুজিবও সে সময় সারা দেশ চষে বেড়িয়ে ঠিক তাঁর মতোই আরো কিছু রাজনৈতিক কর্মীর সন্ধান পেয়েছিলেন। তাঁদের ওপর ভরসা করেই তিনি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সাত-সমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ি দেওয়ার মতো সাহস করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে আবার ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর বেইমানি করে ভোল পাল্টে ফেলেছিলেন। সে রকমই একজন নিমক-হারাম এবং ইতিহাসের জঘন্য ও ঘৃণ্যতম মানব বাংলার আরেক নব্য ‘মীরজাফর’ খ্যাত খন্দকার মোশতাক আহমদ। কিন্তু সে সময়ের বেশির ভাগ ত্যাগী বিশ্বস্ত রাজনীতিক এবং তাঁদের সুযোগ্য উত্তরসূরি নেতারাই আজও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের দায়িত্বশীল বিভিন্ন পদে কর্মরত রয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের কালের সাক্ষী হয়ে এবং সহযোদ্ধা হয়ে অনেকেই ছিলেন কিন্তু তার মধ্যে একনিষ্ঠ সহচর হিসেবে যাঁরা তাঁদের জীবন দিয়ে সেটা প্রমাণ করে গেছেন সেই জাতীয় চার নেতার নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, যাঁদের জন্য আজকের এই লেখা।
এঁরা ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপরাষ্ট্রপতি অধ্যাপক সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান। তাঁরা চারজনই আমরণ বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। এটি সহজেই বোঝা যায় যে, তাঁরা যদি সেদিন বঙ্গবন্ধু, দেশ ও জাতির সঙ্গে বেইমানি করতেন তাহলে তাঁরাও ইতিহাসের খলনায়ক ও মীরজাফর খ্যাত খন্দকার মোশতাক আহমদের মতোই পুরস্কৃত হতে পারতেন। কিন্তু দেশ ও জাতির স্বার্থে জীবন গেলেও তাঁরা সেদিন তা করেননি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তীতে তাঁরা কারাবন্দি হন এবং কারাগারেও তাঁরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতিই আস্থা প্রকাশ করার অপরাধে ওই বছরেরই ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে তাঁদের জীবন দিতে হলো। সে জন্যই দেশ ও জাতি শ্রদ্ধাভরে আজও তাঁদের স্মরণ রেখেছে।
জাতীয় বীর এ চার নেতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার কারণে তাঁরই নির্দেশে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে পুরো নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমরা সবাই জানি, জেলখানা হলো চোর-গুণ্ডা, ডাকাতদের জন্য একটি শোধনাগার। আর রাজনীতিবিদদের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন বিশ্রামাগারও বলা যেতে পারে। কিন্তু জেলখানা হলো সবার জন্য একটি নিরাপদ জায়গা। জাতির জনকও তাঁর রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সময় জেলখানাতেই কাটিয়েছেন। কিন্তু যে কারণে আর যাদের জন্যই হয়ে থাকুক না কেন অনেক সময় জনরোষ থেকেও রক্ষা করার জন্য কাউকে কাউকে জেলখানায় নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় রাখা হয়েছিল ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির পরে, প্রতিবিপ্লব ঠেকানোর ভয়ে! কিন্তু এটাই হলো ইতিহাসের কলঙ্কময় সেই অধ্যায়, যেখানে জেলখানাতেও তাঁরা নিরাপদ থাকতে পারেননি। মাত্র চার-পাঁচ বছর আগে যাঁদের পরিশ্রমের ফসল হিসেবে এবং তাঁদেরই সুযোগ্য দিক-নির্দেশনায় এদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই তাঁদেরই অন্ধকার কারাগারের প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপিত হতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভবিষ্যতেও যাতে কেউ আর বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কথা বলতে না পারে সে জন্য জেলখানাতেই সেই জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।
পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিরল। জাতীয় এই চার নেতার সুযোগ্য সন্তান হিসেবে আজ দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে হিসেবে ছিলেন তানজিম আহমদ সোহেল তাজ, সাবেক এমপি ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যিনি দেশ থেকে চলে যাওয়ার পরে তাঁরই বড় বোন সিমিন হোসেন রিমি এখন একজন সংসদ সদস্য। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ছেলে মোহাম্মদ নাসিম যিনি সাবেক সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানের ছেলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন যিনি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। এঁরা শুধু তাঁদের বাবার গুণেই যে নেতা হয়েছেন তা কিন্তু নয়, বরং তাঁরা স্ব-মহিমায় ও যোগ্যতায় আজ দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
’৭৫-পরবর্তী সময়ে এসব পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যকেই নিরাপত্তার জন্য দেশের বাইরে দুঃখ কষ্টে আশ্রয় ভিক্ষা করে থাকতে হয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই চার নেতার খুনি এবং বঙ্গবন্ধুর খুনি একই এবং একইভাবে একই কায়দায় তাঁদেরও হত্যা করা হয়েছে। তাঁদেরও ভোররাতে জেলখানার ভেতর ব্রাশ ফায়ারিংয়ের মাধ্যমে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে ঘাতকেরা। সেই খুনের মাধ্যমে ঘাতক ক্ষমতালিপ্সুরা যা চেয়েছিল, তার কিছুটা তখন অর্জন করেছিল বৈকি। কারণ এসব খুন-রাহাজানির মাধ্যমে দেশে যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল তা দিয়ে সামরিক স্বৈরতন্ত্র, ক্ষমতা দখল, পাল্টা দখলের রাজনীতি দিয়ে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত চালিয়ে দিতে পেরেছিল। তারপর যদিও বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু নব্য স্বৈরাচারদের দ্বারা আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী প্রচার-প্রচারণার ফাঁদে দেশের জনগণকে এক প্রকার জিম্মি করে আরো কিছুদিন এ খেলা চলতে থাকে। তারপর আবার নতুন লেবাসে এক-এগারো খ্যাত আরেকটি সরকার জনগণের ওপর চেপে বসেছিল যা বঙ্গবন্ধুকন্যার মানসিক দৃঢতার জন্য আর খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন দেশে একটি স্বাধীনতাপন্থী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কাজ করছে এবং এতে দেশ মাত্র পাঁচ-ছয় বছর সময়ের মধ্যে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। ঠিক তখনই আবার স্বাধীনতাবিরোধী চক্র যাদের এই স্বাধীন দেশে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে, তারা দেশকে নানা অজুহাতে কারণে-অকারণে অস্থিতিশীল করে তুলছে। কিন্তু এখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এখন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের পরিস্থিতি নেই। সে কারণেই জেলহত্যা মামলার রায় বাস্তবায়নের জন্য জীবিত খুনিদের বিদেশ থেকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকরের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই তাঁদের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। আর ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর কেউ সাহস করবে না কোনোদিন।
লেখক : রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।